৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৭

সাহস পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা

ব্যাংকগুলো প্রচুর ঋণযোগ্য তহবিল নিয়ে বসে আছে। ঋণের সুদহার নেমেছে উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত এক অঙ্কে। বিনিয়োগকারীদের সেবা দিতে কিছু ক্ষেত্রে চালু হয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস। তবুও বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। এর বড় কারণ করোনাভাইরাসের প্রভাব। করোনা পরিস্থিতিতে অনেক খাতের পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে গেছে। ফলে আপাতত ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা উদ্যোক্তারা করছেন না। তারা বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছেন না। করোনাভাইরাসের প্রভাব ছাড়াও দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির কারণেও বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে।

বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বিষয়টি শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজের আমদানি কমে যাওয়ার পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৯ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৯ শতাংশের বেশি। অন্যান্য মূলধনি পণ্য আমদানিও সাড়ে ৭ শতাংশ কমেছে। কারখানা সম্প্রসারণ, সংস্কার ও নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়।

কেন কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানি কম- এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম পারভেজে সমকালকে বলেন, বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন ধীরগতি রয়েছে। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে খুব কম। কৃষিপণ্য ও ওষুধ ছাড়া অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমেছে। বেশিরভাগ কারখানা উৎপাদন ক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না। এ কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শিল্প খাতের উৎপাদনের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ভারী অনেক শিল্পে উৎপাদন কমেছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ কমেছে। দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন ২ শতাংশ
কমেছে। কাগজের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। এমএস রড ৯ শতাংশ, সিগারেট ৮ শতাংশ, চা ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমেছে। তবে এ সময়ে সাবান, ডিটারজেন্ট, ওষুধ, দেয়াশলাই ও সারের উৎপাদন বেড়েছে।

পোশাক খাতের একজন শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত এক বছরে তার কোম্পানির প্রায় সাড়ে চারশ মেশিন নষ্ট হয়েছে। রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়ার কারণে তিনি এসব মেশিন মেরামত করেননি। নিয়মিত যেসব যন্ত্রাংশ কিনতে হতো, তাও এখন কম কিনছেন। তিনি বলেন, বাজারে পণ্যের চাহিদা ও দাম দুটোই কমেছে। চাহিদা থাকলে নানা সমস্যার মধ্যেও উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে এক লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে শিল্প খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করে, যা ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা বা ১৭ শতাংশ কম। ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে নিট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৭৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। যদিও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, দেশি বিনিয়োগের নিবন্ধন ২০ শতাংশ বেড়েছে। তবে নিবন্ধন মানেই বিনিয়োগ নয়। অনেক নিবন্ধন সবশেষে বাস্তবায়ন হয় না।

গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। তবে বিনিয়োগ একেবারেই যে হচ্ছে না, তা নয়। যারা সরকারের বা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা বিনিয়োগ করছেন। একই সঙ্গে যারা অনেক বড় হয়ে গেছেন এবং ক্ষমতা যাদের জন্য সমস্যা নয়, তারা বিনিয়োগ করছেন। কিন্তু যারা ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত নন, তারা বিনিয়োগ নিয়ে আসার সাহস পাচ্ছেন না। এর অর্থ হচ্ছে, বিনিয়োগের পুরোনো সমস্যা দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এক কথায় সুশাসনের ঘাটতি রয়ে গেছে।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত বছর ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে এক জরিপ চালায়। ওই জরিপে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, কুমিল্লা ও বগুড়ার ব্যবসায়ীরা অংশ নেন। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের ৭২ শতাংশ বলেন, অদক্ষ সরকারি প্রশাসন ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক নম্বর সমস্যা। আর ৬৮ শতাংশ ব্যবসার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দুর্নীতিকে তুলে ধরেন। ৬৬ শতাংশ বলেছেন, চাহিদা অনুযায়ী ঋণ না পাওয়ায় তারা ব্যবসা বাড়াতে পারছেন না। এছাড়া জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা দুর্বল অবকাঠামো, উচ্চ করহার, অদক্ষ শ্রমিক, দুর্বল শ্রমনীতি, বারবার নীতি পরিবর্তন, জটিল কর ব্যবস্থা ও মূল্যস্ম্ফীতিকে বিনিয়োগ বা ব্যবসার বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

এসিআই গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিস উদ দৌলা সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সব ক্ষেত্রে চাহিদা কমেছে। মানুষের আয়ও কমেছে। ফলে বিনিয়োগ চাহিদাও কম। এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেখা যাচ্ছে। এতে করে উদ্যোক্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকে ঋণযোগ্য তহবিল থাকলেও তা নেওয়ার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আশার কথা, টিকা এসেছে। এখন এর সুষম বণ্টন জরুরি। অনেক দেশে টিকা বণ্টন নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে, আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হচ্ছে। কমপক্ষে ৫০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা গেলে একটা ভরসা তৈরি হবে। তিনি বলেন, সরকার টিকা দেওয়ার সুন্দর পরিকল্পনা করেছে। এখন এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন দরকার। ভয় হচ্ছে, বাংলাদেশে লাইন ভাঙার উদাহরণ আছে। তিনি বলেন, আগামীতে যখন বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তখন উদ্যোক্তারা যাতে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পান সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে ১৭ কোটি মানুষের বাজার রয়েছে। মানুষের জীবনমান বেড়েছে। নতুন ধরনের পণ্য ও সেবার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু নতুন একজন উদ্যোক্তার বাজারে প্রবেশ মোটেও সহজ নয়। অন্যদিকে একটি বিনিয়োগ কার্যক্রমে ৩০ থেকে ৩২ ধরনের অনুমোদন দরকার পড়ে। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা বলা হলেও তা এখনও সবক্ষেত্রে চালু হয়নি। বিমানবন্দরের সেবা, শহরের যানজট, জমির প্রাপ্যতার সমস্যা এখনও রয়েছে।

ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীন বলেন, বিনিয়োগ শুধু সুদহার এবং ব্যাংকের অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল নয়। এর সঙ্গে আরও অনেক বিষয় সম্পৃক্ত। সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হতে হবে। বিনিয়োগ তখনই বাড়বে যখন বিনিয়োগকারীরা ঝামেলামুক্ত হয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে উৎপাদিত পণ্য নিয়ে সহজে বাজারে প্রবেশ করতে পারবেন।

ইফাদ গ্রুপের পরিচালক তাসফিন আহমেদ বলেন, করোনার কারণে চাহিদা কমেছে। ফলে বিনিয়োগে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। উদ্যোক্তারা কারখানা সম্প্রসারণ বা নতুন কার্যক্রম হাতে নিচ্ছেন না। তবে তথ্যপ্রযুক্তি এবং ই-কমার্সে বিনিয়োগ বেড়েছে। পণ্য পরিবহনের ছোট গাড়ির চাহিদাও বেড়েছে। তিনি বলেন. এখন টিকা এসেছে। আশা করা যাচ্ছে আগামী ৬ মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বিনিয়োগও বাড়বে। নিউএজ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, এই মুহূর্তে করোনা বিনিয়োগের মূল বাধা। নতুন বিনিয়োগ বা সম্প্রসারণের চেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন অধিকাংশ।

গত বছর আরেকটি জরিপ করে আরেক গবেষণা সংস্থা সানেম। তাতে ২২টি জেলার ১৫৩টি উৎপাদন খাতের এবং ১৫০টি সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের ৮৮ শতাংশ দুর্নীতিকে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া বাণিজ্যের কাঠামোগত সমস্যা (বন্দর এবং কাস্টমস), অপ্রতুল সরকারি সাহায্য, কর ব্যবস্থায় সমস্যা, আর্থিক সেবা প্রাপ্তিতে সমস্যা, ব্যবসা বা সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনে জটিলতা, পরিবহন ব্যবস্থা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং বিদ্যুৎ সংযোগ প্রাপ্তির সমস্যার কথা বলেছেন।

https://samakal.com/economics/article/210251713