৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৫

অক্ষত বাঁধ নড়বড়ে দেখিয়ে বরাদ্দ ৯ কোটি টাকা

সব কিছুই পরিপাটি। বাঁধটির বেশির ভাগ অংশই অক্ষত। তার পরও ফসল রক্ষা বাঁধ নড়বড়ে দেখিয়ে প্রায় নতুন বাঁধের বরাদ্দ পেয়ে নয়ছয়ের আয়োজন চলছে। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার বোরোভাণ্ডার খ্যাত ছায়ার হাওরের বাঁধে পড়েছে এই অশুভ ছায়া। মূল বাঁধের উচ্চতা, স্ল্যাব, কমপেকশনসহ প্রায় সব কিছুই ঠিকঠাক। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বিশেষ সার্ভে দল মনগড়া প্রাক্কলন করে প্রায় ৯ কোটি ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ নির্ধারণ করে। এ রকম প্রেক্ষাপটে সরকারের বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে বলে স্থানীয় কৃষকরা অভিযোগ করেছেন।

এদিকে ওই টাকা বরাদ্দের পর নির্ধারিত সময়ের দেড় মাস পার হলেও এখনো কাজই শুরু হয়নি। গত রবিবার সন্ধ্যার আগে আগে মাউতি বিলের দক্ষিণের প্রকল্পে বাঁধ থেকেই এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কেটে বাঁধেই ফেলতে দেখা গেছে, যাতে বাইরে থেকে কেউ দেখলে বাঁধ নতুন মনে করে। ওই ফসল রক্ষা বাঁধের অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে পদে পদে অনিয়মের ছবিই ফুটে উঠেছে।

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ছায়ার হাওরটি সুনামগঞ্জের শাল্লা, কিশোরগঞ্জের ইটনা এবং নেত্রকোনার খালিয়াজুরী এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। তবে শাল্লায়ই প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষিজমি রয়েছে। চার হাজার ৬৩৭ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে এই হাওরে এ বছর প্রায় চার হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ রয়েছে। আবাদ করা এই জমি থেকে প্রায় ১৮ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হওয়ার কথা, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭২ কোটি টাকা।

শাল্লা উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছায়ার হাওরের প্রকল্প শুরু হয়েছে নোয়াগাঁও-আঙ্গারুয়া ৯৭ নম্বর প্রকল্প থেকে। শাল্লার উজানগাঁওয়ে এসে এই হাওরের ৬০টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। পাউবোর শাল্লা উপজেলার উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুল কাইয়ুমসহ সার্ভেয়ার আব্দুল জলিল, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও নাঈম হোসেন সার্ভে করে ৫৬ কিলোমিটার বাঁধের জন্য ৯ কোটি ১১ লাখ টাকা প্রাক্কলন ব্যয় নির্ধারণ করেন। পরে ৬০টি প্রকল্পে এই বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে ৩০ শতাংশ বরাদ্দের টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে। গত রবিবার ৯৭ নম্বর প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, বিধ্বস্ত সেতুর পূর্ব দিকে গেল বছরের একটি প্রায় অক্ষত বাঁধ রয়ে গেছে। ওই প্রকল্পের আওতায় বাঁধটির সাত থেকে আট হাত দৈর্ঘ্য ভাঙা। কিন্তু এই প্রকল্পেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এর পাশেই আঙ্গাউরা ৩০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুর মুখ বন্ধ করতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আট লাখ ৬৫ হাজার টাকা।

এরপর শাল্লা কলেজের পেছনের সেতুর নিচ থেকে শুরু হয়েছে প্রকল্প। সেতুর নিচ থেকে দাড়াইন নদীর তীর ধরে অন্তত ২০ কিলোমিটার ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ বাঁধেরই অবকাঠামো অক্ষত। কিন্তু বেশির ভাগ প্রকল্পেই অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট করার আয়োজন চলছে। হাওরের ৯৭ নম্বর থেকে ১৫৬ নম্বর প্রকল্প পর্যন্ত সরকারি বরাদ্দ লোপাটের সুযোগ করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। শুধু বরাদ্দে চাতুরীই নয়, প্রকল্প অনুমোদনেও নেওয়া হয়েছে দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয়। আর্থিক সুবিধা নিয়ে হাওরে জমি নেই, বাঁধ এলাকার কৃষক নয়—এমন একাধিক প্রকল্পও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব নিয়ে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানে অনিয়ম ও দুর্নীতিরও লিখিত অভিযোগ করেছেন কৃষকরা।

সুলতানপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান বলেন, ‘শাল্লা কলেজের পেছনের দাড়াইন নদী থেকে শুরু করে ছায়ার হাওরের বেশির ভাগ প্রকল্পই অক্ষত। মূল অবকাঠামোতেই আছে বাঁধ। কিন্তু যেভাবে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তাতে সরকারি টাকা লোপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।’

শাল্লার আঙ্গাউড়া গ্রামের কৃষক শনি দাস বলেন, ‘আমাদের এলাকার দুটি প্রকল্পেই বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেখানে এক থেকে দুই লাখ টাকা দিলেই হতো, সেখানে দেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। সরকারি টাকা কিভাবে লুটপাট হচ্ছে, এটা তার বড় একটা উদাহরণ।’

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের শাল্লা শাখার সহসভাপতি দুর্গাচরণ দাস বলেন, ‘শুধু ছায়ার হাওরই নয়, শাল্লার সব উপজেলায়ই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তার পরও কাজ শুরু হয়নি।’

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাল্লা উপজেলা উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘এ বছর বন্যার কারণে পানি দেরিতে নামায় প্রাক্কলন করতে বিলম্ব হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা কমিটিও প্রকল্প অনুমোদন দিতে দেরি করেছে। তবে দু-এক দিনের মধ্যেই কাজ শুরু হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের সার্ভে দলের প্রাক্কলনেই বরাদ্দ ঠিক হয়েছে। এতে কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/02/04/1001598