৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১০:৫১

বেসিক ব্যাংক নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

সেই পুরোনো অনিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটছে

শীর্ষ ২০ খেলাপির হাতে আটকা প্রায় ২২শ কোটি টাকা - ভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকরা হাতিয়ে নিয়েছে ১৬১ কোটি টাকা - ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেই, মানা হচ্ছে না চাকরিবিধি

বেসিক ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির হাতে এখনো আটকে আছে ২ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির মোট ঋণের ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। এছাড়া একাধিক ব্যাংকের আটজন পরিচালক (বর্তমান ও সাবেক) এই ব্যাংক থেকে ১৬১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার ১৩৫ কোটিই এখন খেলাপি। পাশাপাশি ৪ হাজার ৯২০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে ৩০ জন গ্রাহককে।

প্রত্যেকের ঋণের পরিমাণ একশ কোটি টাকার ওপরে। এই বিপুল অঙ্কের ঋণের প্রায় ২৮শ কোটি টাকাই বিরূপমানের শ্রেণিকৃত হয়ে পড়েছে। এত দায় থাকার পরও ১ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ করেছে ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংকে এখনো আগের অনিয়মেরই পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মানা হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশাবলিও।

সূত্র বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে সম্প্রতি পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসবই তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, নির্দেশ থাকার পরও অনেক নিয়মই পালন করা হচ্ছে না। এ থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, ব্যাংকের করপোরেট গভর্ন্যান্স ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক।

জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণায়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বাণিজ্যিক ব্যাংক) অরজিৎ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন নিয়ে প্রথমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বোর্ডের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈঠক করবে। সেখানে সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দেওয়া হবে। পরে সেটি পাঠানো হবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে। তবে প্রতি তিন মাস অন্তর বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের নিয়ে বৈঠক করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিদর্শন রিপোর্ট নিয়ে ফলোআপ করা হয়। বেসিক ব্যাংকের রিপোর্টও ফলোআপ করা হবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে।

যোগাযোগ করা হলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবুল হাসেম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন সম্পর্কে আমার জানা

নেই। এ বিষয়ে তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

বেসিক ব্যাংকের এমডি রফিকুল আলম যুগান্তরকে বলেন, আগের তুলনায় অনিয়মের পুনরাবৃত্তির হার কমেছে। এখন সে রকম অনিয়ম আর বাড়ছে না। এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, এক সময় বেসরকারি আদলেই এ ব্যাংক পরিচালিত হয়েছে। ফলে নিয়মকানুনে এতটা কঠোর ছিল না। এখন পরিচালনার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। আশা করি নিয়মের ব্যাপারে বেসিক ব্যাংক সম্পর্কে আগামীতে যে অডিট বিভাগ রিপোর্ট দেবে সেখানে ইতিবাচক বিষয়টি উঠে আসবে।

সূত্র মতে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের ৭২টি শাখার ওপর সব ধরনের সূচক বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনার কারণে ২০২০ সালের তথ্য প্রতিবেদনে আনা হয়নি। সেখানে বলা হয়, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক থেকে একক ব্যক্তি হিসেবে ঋণ পাওয়ার সীমা লঙ্ঘন করে ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিয়েছে বেসিক ব্যাংক। এর মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি এনেছে। বাকি দুটি ফিজার গ্রুপ এবং ওয়েল টেক্স ও আদিব ডায়িং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনাপত্তি দেয়নি।

এর মধ্যে ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ১৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ অর্থাৎ ১৯০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয় ফিজার গ্রুপকে। আর ওয়েল টেক্স ও আদিব ডায়িংকে দেওয়া হয় ১৮৯ কোটি টাকা। এটি পরিশোধিত মূলধনের ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি একক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার বিধান নেই। এ নিয়ম লঙ্ঘন করে ঋণ দিয়েছে বেসিক ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম দেখেছে, ব্যাংকের মোট ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ১৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা বিরূপমানের শ্রেণিকৃত ঋণ। এটি মোট ঋণের ৫২ শতাংশ। বিপরীতে আদায় হয়েছে ১৯৭ কোটি টাকা। এই সময়ে ৩২৩টি ঋণের বিপরীতে ১ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বিরূপমানের শ্রেণিকৃত ঋণ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এছাড়া এ ব্যাংকের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশই ২০ শীর্ষ খেলাপির হাতে। খেলাপিসহ বিভিন্ন নামে মোট ৩ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই খেলাপি চক্র। তাদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত আদায় করা গেছে মাত্র ২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এটি মোট খেলাপির ১ দশমিক ১৩ শতাংশ।

শীর্ষ ২০ খেলাপির মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন আইজি নেভিগেশনের ১২০ কোটি টাকা, ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপ বিল্ডার্সের ১১৭ কোটি টাকা, কক্স ডেভেলপারের ১০৪ কোটি টাকা ও এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের ১০২ কোটি টাকা। এছাড়া মেসার্স মা টেক্স, মেসার্স এসপিএন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স রিলায়েন্স শিপিং লাইনস, মেসার্স ডায়মন্ট এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স এ্যাপোলো ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লি. রয়েছে।

ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নিয়োগ প্রক্রিয়াসহ নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রণয়নকৃত ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কাঠামোতে সুষ্ঠু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উপাদান, নীতি ও পদ্ধতি, মূলধন ব্যবস্থাপনা, পর্ষদ, পর্ষদ কমিটি ও ঊর্ধ্বতন ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু পরিদর্শনকালে এটি প্রতীয়মান হয়েছে যে, একটি কার্যকরি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পর্ষদসহ কোনো পর্যায়েই সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালনের বিষয়টি পুরোপুরি পরিলক্ষিত হয়নি। ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পর্ষদ ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার তদারকির অভাব রয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, প্রণোদনা সম্পর্কিত নীতি, চাকরিবিধি সম্পর্কিত নির্দেশনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা (গাইডলাইন অন ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স ইন ব্যাংক) মানা হচ্ছে না।

আর বিভিন্ন শাখার কার্যক্রম ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এখনো দুর্বল রয়েছে। ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, টাকা রাখার ভল্ট, শাখার ইনফরমেশন টেকনোলজি ব্যবস্থাও দুর্বল। এছাড়া এই ব্যাংকে এখনো কোর ব্যাংকিং পদ্ধতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।

নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না ছেঁড়া নোট, নতুন ও পুনঃপ্রচলন নোট এবং ধাতব মুদ্রা বিনিময় কার্যক্রমের ক্ষেত্রে। এসব অনিয়ম ও ঝুঁকি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলা হলেও বাস্তবায়নে সব শাখা এটি সাধারণ বিষয় মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/390433/