৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৮

শতফুল ফুটতে দাও

জনগণের টাকা জলে ফেলার আরেকটি দৃষ্টান্ত

শৈশব থেকে শুনে আসছি, প্রতি ১০ বছরে একবার মানুষ গণনা করা হয়। একটি দেশের লোকসংখ্যা কত, এদের পেশা কী, কোন্ ধর্মের উপাসক এরা, এদের শিক্ষাগত যোগ্যতাই বা কী, এদের বৈবাহিক অবস্থা কী ইত্যাদি তথ্য আমরা জানতে পারি প্রতি ১০ বছরে একবার মানুষ গণনা করা থেকে।

মানুষ গণনার এ কাজটিকে ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি ‘আদমশুমারি’ নামে। কিন্তু এখন দেখছি আদমশুমারির পরিবর্তে জনশুমারি শব্দবন্ধটি ব্যবহার করতে।

আদমশুমারি শব্দবন্ধটিতে কী এমন সমস্যা ছিল যে এর জন্য জুতসই একটি মূল বাংলা শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। দীর্ঘকাল ধরে আদমশুমারি শব্দবন্ধটি ব্যবহার করার ফলে যাদের গণনা করা হচ্ছে তারা কেউ ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু বা মুসলমান হয়ে যায়নি।

দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, একদল পণ্ডিত বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি-ফার্সি শব্দগুলোকে পারলে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেন। অথবা কোনো কিছু লিখতে গিয়ে ওগুলো সাবধানতার সঙ্গে পরিহার করেন। এ রকম প্রয়াসের ক্ষেত্রে এসব পণ্ডিত ভাষার ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলা ভাষার বয়স কম নয়।

অতীত ইতিহাস যতটুকু উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তা থেকে আমরা জানি ভাষাটি সময়ের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেক বিদেশি শব্দ আত্মস্থ করেছে। ফলে কোনোক্রমেই ভাষার মর্যাদাহানি হয়নি। বরং অনেক বেশি প্রাঞ্জল এবং মনের ভাব প্রকাশের জন্য সহায়ক হয়েছে। বাংলা ভাষারও শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছে।

ইংরেজি ভাষা শুধু ইংল্যান্ডবাসীরই মাতৃভাষা নয়, অধিকন্তু তাদের মনের ভাব স্বাচ্ছন্দ্যে প্রকাশের মাধ্যমও বটে। বিশ্বের অনেক দেশে ইংরেজি ভাষা মাতৃভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা।

এ একবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি ভাষার অভিধানগুলোতে এমন সব শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে যেগুলো আদতেই ইংরেজি নয়। এসব শব্দ অন্য ভাষা থেকে ইংরেজিতে প্রবেশ করেছে। ফলে ইংরেজি ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। একইভাবে আমরা বলতে পারি বাংলা ভাষাতেও প্রচুর বিদেশি ভাষার শব্দ প্রবিষ্ট হয়েছে এবং সেগুলো বাংলা ভাষার সঙ্গে অত্যন্ত মোলায়েমভাবে মিশে গেছে।

তবে বাংলা ভাষার ইসলামিকরণের একটি মেকি প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের অনেকের পড়া ছোটবেলার কবিতার প্রথম লাইনটি ছিল, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি।’ এ ছত্রটিকে ইসলামিকরণ করতে গিয়ে করা হলো, ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি।’

মূল কবির লেখার ওপর এ রকম হস্তক্ষেপের অধিকার কারও নেই। এ হস্তক্ষেপের ফলে কবিতাটি শিশুদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছিল। শিশুদের মধ্যে সুচিন্তা, সৎব্যবহার এবং ভালো কাজ করার স্পৃহা সৃষ্টির মাধ্যমে যে নৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়েছিল তা প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভাষা বহতা নদীর মতো।

নদী যেমন তার প্রবাহ পথে অনেক কিছু গ্রহণ ও বর্জন করে, ভাষাও তেমনি গ্রহণ বর্জনের পথ ধরে চলে। কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় প্রচুর আরবি, ফার্সি, ইংরেজি এবং সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেছেন। এর ফলে এসব কবিতা ভাব প্রকাশের শক্তিশালী বাহন হতে পেরেছে।

আদমশুমারি শব্দবন্ধটি এমন যে বাংলা ভাষায় এটি খুব সহজে মিশে যেতে পেরেছে। ভাষাকে জোরজবরদস্তি করে কোনো আইডিওলজির সঙ্গে অথবা সাম্প্রদায়িক মনোভাবের সঙ্গে জোর করে মেলাতে গেলে মিলন অর্জিত হয় না।

২ ফেব্রুয়ারির একটি সংবাদপত্র থেকে জানা গেল, ‘৩২ কোটি টাকা জলে গেল’। পত্রিকাটি সংবাদের সারাংশ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছে, ‘আসন্ন জনশুমারির আগে খানাপ্রধানের তালিকা তৈরির পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়েছে। তার আগেই খরচ হয়ে গেছে ৩২ কোটি টাকা।’

খানাপ্রধান শব্দটি অনেকেই হয়তো বুঝতে পারেন না। খানা শব্দটির সঙ্গে খাওয়া শব্দটির চমৎকার একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা অনেক সময় অভ্যাগতদের প্রশ্ন করি, আপনি কি আপনার খানা খেয়েছেন? যারা সাধারণত একই চুলার রান্না থেকে খাবার খায় তাদের নিয়েই গঠিত হয় একটি খানা। সব খানার সদস্য একই রকম নয়। নানা কারণে খানাগুলো বিচিত্রভাবে গঠিত হতে পারে।

আমরা অনেক সময় পরিবারপ্রধান শব্দটিও ব্যবহার করি। পরিবার রক্ত সম্পর্কে সম্পর্কিতদের নিয়ে গড়ে ওঠে। কিন্তু খানায় কাজের মানুষ এবং লজিং মাস্টারও থাকতে পারে। এরা খানার অন্য সদস্যদের সঙ্গে রক্ত সম্পর্কে সম্পর্কিত নয়। আশা করি পাঠকের কাছে খানা এবং পরিবারের পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাধারণত আদমশুমারির কাজটি শুরু হয় দশকের প্রথম বছরের প্রথম মাস থেকে। চলতি বছর ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে আদমশুমারি শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে আদমশুমারির কাজটি পিছিয়ে দিয়ে অক্টোবরে নির্ধারণ করা হয়।

এবারের আদমশুমারি শুরুর আগে খানাপ্রধানদের তালিকা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়। শেষ পর্যন্ত খানাপ্রধানদের পৃথকভাবে তালিকা করার কাজটি এবং তাদের সম্পর্কে মৌলিক তথ্য সংগ্রহ করার কাজটিও বাতিল করা হয়। এতদিন আদমশুমারি করতে গিয়ে খানাপ্রধান সম্পর্কে আলাদাভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হতো না।

কিন্তু খানাপ্রধান সংক্রান্ত এবারের আদমশুমারির কাজটি খুবই প্রাসঙ্গিক ও উপযোগী ছিল। যিনি খানাপ্রধান তার প্রধান পেশা, অ-প্রধান পেশা, ধর্মীয় পরিচয়, বিশেষ কোনো দক্ষতা, দক্ষতার পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, খানাপ্রধানের সঙ্গে খানার অন্য সদস্যদের সম্পর্ক, খানাপ্রধান বিদেশে অবস্থান করেন কিনা, খানাপ্রধানের ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ এবং সমাজে খানাপ্রধানের ভূমিকা- ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করা গেলে আদম শুমারিটি সত্যিকার অর্থে অনেক বেশি মূল্যবান হতো।

এ ছাড়া খানাপ্রধানের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপারেও তথ্য সংগ্রহ করা যেত। অথচ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হবে ভেবেও শেষ পর্যন্ত না করার সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে সীমিত করে রেখেছে। খানাপ্রধান সংক্রান্ত কাজটি বাতিল করা হলেও এ কাজের জন্য ৩২ কোটি টাকার উপকরণ কেনা হয়ে গেছে।

এখন এসব উপকরণ আর ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ ৩২ কোটি টাকাই পানিতে গেল। এ উপকরণগুলো আদমশুমারির অন্য কোথাও ব্যবহারের সুযোগ নেই। এসব উপকরণ বিক্রি করে দেওয়া কিংবা পুড়িয়ে ফেলা অথবা ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই ৩২ কোটি টাকার উপকরণ কীভাবে ফেলে দিতে হবে, সে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও বেশ ক’টি মিটিং এবং আনুষঙ্গিক কাজ করতে হবে। এতে আরও খরচের বহর বাড়বে।

মানুষ যখন একটি কাজ করবে বলে মনস্থ করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন করা হয় না, তখন তারা নানা রকম ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের প্রবোধ দিতে চায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এখন সেভাবেই নিজকে বুঝ দিতে চাচ্ছে। ৩২ কোটি টাকা অপচয়ের পর এ প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকর্তা বলতে চাচ্ছেন, ৩২ কোটি টাকা পানিতে গেলেও খানাপ্রধানের তালিকা বা লিস্টিং করার জন্য বরাদ্দ রাখা ৩৫৫ কোটি টাকা বেঁচে যাচ্ছে। ৩৫৫ কোটি টাকা যে উপায়ে বাঁচানো হচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে সেটি ভয়ানকভাবে খোঁড়া একটি যুক্তি।

কারণ খানাপ্রধানের তালিকা ও বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা গেলে সে তথ্য ব্যবহার করে সরকার অনেক বেশি সক্ষমতার সঙ্গে উন্নয়নমূলক কাজগুলো করতে পারত। যে ৩২ কোটি টাকা ইতোমধ্যে অপচয় হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে, সেই টাকা দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের আহার কর্মসূচি চালু করা যেত।

শুধু এ কর্মসূচিই নয়, বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রদত্ত ট্যাক্সের প্রতিটি টাকার অনেক বিকল্প ব্যবহার আছে। সুতরাং যারা এ ৩২ কোটি টাকা অপচয়ের জন্য দায়ী, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। অথচ সে রকম কিছু ঘটবে বলে বিচারহীনতার সংস্কৃতির এ দেশে আশা করা যায় না।

পত্রিকাটি আরও তথ্য দিয়েছে। ৪ কোটি খানাপ্রধানের তথ্য সংগ্রহের জন্য লিস্টিং বা তালিকাভুক্তির ফরম ছাপানো হয়েছিল। এ ফরম কীভাবে ব্যবহার করা হবে সে জন্যও ছাপানো হয় লিস্টিং ম্যানুয়েল। এ জন্য খরচ হয়েছে ১০ কোটি টাকা। খানাপ্রধানের তালিকা তৈরির ফরম পূরণ করার জন্য ১১ কোটি টাকার কলম, প্রচারণার জন্য ৭ কোটি টাকার স্টিকার এবং ৪ কোটি টাকার নোটবুক কেনা হয়েছিল। সব মিলিয়ে ৩২ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

এখন দেখতে হবে এ প্রতিক্রিয়া কী করে বাস্তব দৃষ্টান্তে পরিণত হয়। ভালো করে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রকল্পে অনেক বাহুল্য ব্যয় হয়। এ ব্যয় রোধ করা সম্ভব হলে প্রতিবছরই ভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হতো। দেশের উন্নয়নের গতি আরও বেগবান হতো। ভাষা পরিশীলিত করার জন্য যে রকম চিন্তাভাবনা করা হয়, তার কিছু অংশ যদি প্রতিটি প্রকল্পকে আরও সাশ্রয়ীভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হতো, তাহলে জনগণের অনেক কল্যাণ হতো।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/390447