৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১০:২৬

ঢাবি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। শিক্ষার্থীরাও নানা জটিলতায় পার করেছেন করোনাকাল। পারিবারিক ও সমাজিক নানা চাপে বিদ্ধ হতে হয়েছে তাদের। অনেকে সেসব সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীকেও পারিবারিক ও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে করোনাকালীন সময় পার করতে হয়েছে। হতাশা, উদ্বেগ ও সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে এই সময়ে বর্তমান ও সাবেক একাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছিলেন। অনেকে এমন সমস্যার সমাধান খুঁজে না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তরের শরণাপন্ন হয়েছেন। ফিরে এসেছেন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকেও।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে অবস্থিত এই দপ্তরের তথ্য মতে, করোনাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক সহায়তা গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। গত বছরের মার্চে লকডাউন ঘোষণার পর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৩৫৮ শিক্ষার্থী অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দপ্তর থেকে মানসিক সহায়তা নিয়েছেন। অথচ ক্যাম্পাস খোলা থাকার পরও ২০১৯ সালের এই সময়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সেবা নিয়েছিলেন ২৬৮ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি সেবাটি অফলাইনেও চালু থাকতো তাহলে হয়তো এর পরিমাণ আরো বাড়তো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক মেহজাবীন হক বলেন, করোনাকালীন সময়ে পারিবারিক ও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের যেতে হয়েছে। যার কারণে অনেকে অনলাইনে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মানসিক সহায়তা নিয়েছেন। যারা এ সেবা গ্রহণ করেছেন তাদের অধিকাংশই মূলত তিনটি কারণে আমাদের কাছে এসেছেন। সেগুলো হলো- হতাশা, সম্পর্কের টানাপড়েন ও উদ্বেগ। অধ্যাপক মেহজাবীন হক বলেন, আমরা অনেককে ২-৩টি থেকে শুরু করে ৭-৮টি সেশন পর্যন্ত সেবা দিয়েছি। আবার যাদেরকে কাউন্সিলিংয়ের পরও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনা কঠিন হচ্ছে তাদের আমরা চিকিৎসকের কাছে রেফার করেছি। তবে সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে কাউন্সিলরের শরণাপন্ন হওয়া একদিক থেকে ইতিবাচক আবার কঠিন পরিস্থিতিতে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা কমে যাওয়াও উদ্বেগের। কারণ অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা শিখতে হবে। আত্মহত্যা কিংবা নিজেকে পরিবার-সমাজ থেকে দূরে ঠেলে নয়।

ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তরের তথ্য মতে, করোনকালীন সময়ে ক্যাম্পাস বন্ধের পর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অনলাইনে ৩৫৮ জন শিক্ষার্থী মানসিক সহায়তা নিয়েছেন। যাদের মধ্যে ২৫ শতাংশ হতাশায় ভুগছেন, ২২ শতাংশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় এবং ১৪ শতাংশ সম্পর্কের টানাপড়েনে ছিলেন। বাকিরা অন্যান্য মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। অথচ ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ক্যাম্পাস চালু থাকার পরও ২৬৮ শিক্ষার্থী ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তর সেবা নিতে এসেছিলেন। অধ্যাপক মেহজাবীন হক বলেন, আমরা ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তর ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে করোনাকালীন সময়ে বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দিয়েছি। যেখান থেকে অনলাইনে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আমাদের অনেক শিক্ষার্থীও সেবা নিয়েছেন। শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে এই সংখ্যাটি ১ হাজারের অধিক। এদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা আত্মহত্যা করেছে তারা আমাদের কাছে আসেনি। কিন্তু হতাশা, সম্পর্কের টানাপড়েন ও উদ্বেগ গিয়ে অনেকে আমাদের কাছে এসেছে, তাদের আমরা আমাদের কাউন্সিলরদের মাধ্যমে সেবা দিয়েছি। মেহজাবীন হক বলেন, একক কোনো কারণে কেউ আত্মহত্যা করে না। এর পিছনে অনেকগুলো কারণ থাকে। এখানে এমনও আছে যারা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে আমাদের কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ফিরে এসেছে। এদেরকে একটা প্রসেসের মাধ্যমে রাখতে হয়।

তাহলে আত্মহত্যার চিন্তা থেকে সরে আসে। অনেকে বলে আমি আর বাঁচতে চাই না। তখন এদের কাউন্সিলিং করাও কঠিন হয়ে পড়ে। আসলে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে আমরা আত্মহত্যা কমিয়ে আনতে পারবো কিন্তু বন্ধ করা সম্ভব না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, করোনাকালীন সময়ে আমাদের কয়েকজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। তারা সমস্যার জন্য সমাধান খুঁজে পাননি। একটা সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা যেকোনো ব্যক্তিগত ও সামাজিক সমস্যা নিজে নিজে সমাধান করতেন, সবকিছু গোপন রেখে নিজেই সমাধান খুঁজে বের করতেন। কিন্তু এখন শিক্ষার্থীরা অল্প সমস্যাতেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন, পরিবার ও সমাজ থেকে নিজেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। নিজের অর্জিত শিক্ষার সঙ্গে জটিলতাগুলোর সমন্বয় করতে পারছে না। কেউ কেউ কাউন্সিলরের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন, এটা একদিক থেকে ইতিবাচক। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা, একাকিত্ব, হতাশা, চাকরি না পাওয়ার কারণে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে সমন্বয়হীনতার কারণে সহায়তা নিয়ে থাকে। তবে যেকোনো সমস্যায় নিজের অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সমাধান খুঁজে না পাওয়া উদ্বেগের। কারণ আমরা আমাদের সিলেবাস ও কারিকুলাম এমনভাবে তৈরি করেছি যেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সক্ষমতা তৈরি হয়। অতি অল্পতে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া কিংবা তার উপার্জিত শিক্ষাকে জটিল সময়ে কাজে লাগাতে না পারা উদ্বেগের। আমরা প্রত্যাশা করি প্রতিটি শিক্ষার্থী নিজে নিজের মেন্টর হবে। তিনি বলেন, সবকিছুর মধ্যে সমন্বয় করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা রাখার সক্ষমতা তৈরি হতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রত্যেককে মনে রাখতে হবে যে, আমরা আমাদের এক জীবনে সব পাবো না, তার জন্য হতাশায় ঢুবে থাকা, আত্মহত্যা করা কিংবা পরিবার-সমাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখার প্রবণতা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে। সবকিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রেখে চলতে হবে। বাস্তবতাকে মানতে হবে। কোনো কিছু পাইনি বলে একাকিত্ব, হতাশাকে স্থান দেয়া যাবে না। সমাজ ও পরিবারের থেকে দূরে থেকে নয় বরং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সংগ্রাম করে টিকে থাকা পরিচ্ছন্ন চিন্তা ও আনন্দচিত্তে যে কোনো কাজ করতে পারাই সফলতা।

যেকোনো ধরনের জটিল সমস্যা সমাধানে নিজের মেধাকে কাজে লাগানোর প্রবণতা তৈরি করতে হবে। কারো কারো ক্ষেত্রে সেবা নেয়াটাও ইতিবাচক। তবে আমাদের নিজেদের মধ্যে সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। এদিকে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, আমরা করোনার শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। যখনই কোনো শিক্ষার্থী সমস্যায় পড়েছেন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর আমরা সমাধানে কাজ করেছি। সেটি আমাদের হল প্রভোস্ট, বিভাগ এবং ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তর যেখানেই যোগাযোগ করেছেন যেখান থেকে তার সমস্যাটা প্রাসঙ্গিক আমরা সেখান থেকে সমাধান করার চেষ্টা করেছি। আমরা আমাদের সহযোগিতার এ ধারা অব্যাহত রেখেছি। শিক্ষার্থীরা যেকোনো সমস্যায় যোগাযোগ করলে আমাদের সহযোগিতা পাবেন।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=261330&cat=3