৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১০:২৩

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

৬৮ কোটি টাকার পণ্য ক্রয়ে ২১ অনিয়ম

৭ দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে জবাব দেওয়ার নির্দেশ * ওই সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না -পরিচালক

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটায় ২১টি আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ২০টি গুরুতর এবং একটি কম গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৮ কোটি টাকার এমএসআর (মেডিকেল সার্জিক্যাল রিকুজিট) ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি (রাজস্ব) কেনায় এ অনিয়ম হয়। এর মধ্যে শুধু পিপিআর বিধি লঙ্ঘন করায় ২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষায় এগুলো শনাক্ত হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্র্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলীলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এসব কেনাকাটা যখন হয়েছে, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তবে বর্তমানে দায়িত্বে থাকায় আমাকেই জবাব দিতে হবে। তাই আমি সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র খুঁজে দেখছি। সেগুলো পেলে তার ভিত্তিতেই জবাব দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সহকারী সচিব এমডি কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ওই ২১টি অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে এই চিঠি দেন তিনি। সেখানে সাতদিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হাসপাতাল পরিচালককে এর জবাব দিতে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গুরুতর আর্থিক অনিয়ম (সিরিয়াস ফিন্যান্সিয়াল ইরেগুলারিটিজ) হিসাবে চিহ্নিত ২০টি অডিট আপত্তি ব্রডশিটে জবাব দিতে হবে। এছাড়া অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর আর্থিক অনিয়ম (নন সিরিয়াস ফিন্যান্সিয়াল ইরেগুলারিটিজ) ৭ দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব এমডি কামাল হোসেন বরাবর পাঠাতে হবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অডিট ইউনিট যেসব অনিয়মের কথা উল্লেখ করেছে সেগুলো হলো : ১. ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি নির্ধারিত এমআরপি (ম্যাক্সিমাম রিটেইল প্রাইস) মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে ওষুধ কেনায় সরকারের ২৮ লাখ ৮৬ হাজার ৪৮০ টাকা আর্থিক ক্ষতি।

২. বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে এমএসআর (এক্সরে ফিল্ম) কেনায় সরকারের ৫০ লাখ ৪৩ হাজার ৯৫৫ টাকার আর্থিক ক্ষতি। ৩. পিপিআর (পাবলিক পকিউরমেন্ট রুল) ২০০৮-এর বিধি লঙ্ঘন করে নির্দিষ্ট সময়ে চুক্তি সম্পাদন ছাড়া ঠিকাদারকে কার্যাদেশ প্রদান এবং মালামাল সংগ্রহ করায় ২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

৪. বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে অ্যামেচার যন্ত্রপাতি কেনায় ১ কোটি ২১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৬০ টাকার ক্ষতি। ৫. সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও ইডিসিএল (অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লি.) উৎপাদিত চিকিৎসাসামগ্রীর দাম কম হওয়ার পরও ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়নি; বরং অন্য সরবরাহকারীর কাছ থেকে বেশি দামে চিকিৎসাসামগ্রী কেনায় ৪৭ লাখ ৬০ হাজার ৭১৩ টাকার আর্থিক ক্ষতি।

৬. চাহিদা না থাকার পরও অতিরিক্ত এমএসআর সামগ্রী কেনা এবং মজুত করায় সরকারের ১ কোটি ৫৫ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ টাকার আর্থিক ক্ষতি। ৭. পরিশোধিত বিল থেকে নির্ধারিত হারে ভ্যাট প্রত্যাহার না করায় ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৫৩ টাকার আর্থিক ক্ষতি।

৮. দরপত্র/কার্যাদেশে উল্লিখিত স্পেসিফিকেশন/কান্ট্রি অব অরিজিন অনুযায়ী এমএসআর চিকিৎসা যন্ত্রপাতিসামগ্রী সরবরাহ না করায় অনিয়মিতভাবে ১ কোটি ৩২ লাখ ৫৭ হাজার ১০০ টাকার আর্থিক ক্ষতি। ৯. টিইসির সুপারিশ এবং কার্যাদেশ অমান্য করে মালামাল গ্রহণ করায় ১৫ লাখ ৪০ হাজার ১৮৮ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

১০. পিপিআর ২০০৮ লঙ্ঘন করে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্ণয় না করায় আর্থিক অনিয়ম। ১১. এমএসআর যন্ত্রপাতি, ডিসপোজেবল আইটেম ও কেমিক্যাল রিয়েজেন্ট বাবদ ৬ কোটি ৩৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৭০ টাকার কোনো বিতরণ হিসাব পাওয়া যায়নি। ১২. নিম্নমানের কম্বল (উলেন) বেশি দামে কেনায় ১১ লাখ ২০ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

১৩. টিইসির নন-রেসপন্সিভ দরদাতাকে রেসপন্সিভ ঘোষণা করে ১ কোটি ৯২ হাজার ৫০০ টাকার আর্থিক অনিয়ম। ১৪. ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তিবহির্ভূতভাবে কার্যাদেশ প্রদান করায় ১ কোটি ৫৪ লাখ ১ হাজার ৮৮০ টাকার অনিয়ম। ১৫. এমএসআর দ্রব্য কেনায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ২৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে।

১৬. চাহিদার অতিরিক্ত (ক্লিয়ার এডেসিভ টেপ-৫ সিএম, ১০ এম) কেনায় ১ কোটি ২ লাখ ১ হাজার ৮৮০ টাকার ক্ষতি। ১৭. আর্থিক ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে চুক্তি সম্পাদন করায় অনিয়মিতভাবে ১৩ কোটি ৪৪ লাখ ১৯ হাজার ৭৯৭ টাকা পরিশোধ করে আর্থিক অনিয়ম। ১৮. আর্থিক ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে কোটেশনের মাধ্যমে মালামাল কেনায় ২৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়ম।

১৯. হাসপাতালের স্টোর থেকে গ্রহণ করা বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ওয়ার্ডের রেজিস্টারে খরচ ও এন্ট্রির প্রমাণ না পাওয়ায় সরকারের ৭২ লাখ ৩৪ হাজার ৭৫৭ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে।

২০. কার্যসম্পাদন জামানত আদায় না করায় ২ কোটি ৯৪ লাখ ৫১ হাজার ৩৭ টাকার আর্থিক অনিয়ম। ২১. মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এমএসআর বিভাজন নীতিমালা উপেক্ষা করে অনিয়মিত পরিশোধের মাধ্যমে ৫ কোটি ১২ লাখ ১৫ হাজার ৮৩৮ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারের এই বিপুল টাকার অর্থিক অনিয়ম হয়েছে। ওই সময় হাসপাতালের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া। নানা অভিযোগে মন্ত্রণালয় তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ওএসডি (অফিসার ইন স্পেশাল ডিউটি) হিসাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ন্যস্ত করে। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/390118