৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১০:১৮

গ্রামে ফেরা মানুষের কর্মসংস্থানের পদক্ষেপ না নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সামাজিক শৃঙ্খলা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : করোনার মহামারিতে অর্থসংকটে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে অনেক মানুষ। করোনা সংকটে কেউ চাকরি হারিয়ে, কেউবা ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন। কেউ সপরিবারে গেছেন গ্রামের দিকে। আবার অনেকে পরিবারকে বাড়ি রেখে এসেছেন। করোনাকালীন পিকআপ বা ট্রাকে করে মালামাল ভরে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হওয়ার দৃশ্য দেখেছে গোটা দেশবাসী। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যে বিপুলসংক্ষক মানুষ গ্রামে চলে গেছেন তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে গ্রামে তারা কাজ পেতে পারেন। থিতু হতে পারেন সেখানে। অন্যথায়, গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত হবে সামাজিক শৃঙ্খলা। এছাড়া নিবিড় তদারকির ভিত্তিতে কৃষকের জন্য জামানতবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করা, কৃষি সহায়তাসমূহ সুষ্ঠুভাবে বিতরণ, কৃষি ঋণ বিতরণে বর্গাচাষি এবং ত্রাণ বিতরণে গ্রামে ফেরা মানুষের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।

করোনা মহামারির কারণে আয় কমে যাওয়া দেশের ৬১ শতাংশ দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষ কোনো সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাননি বলে গত বছরের এক জরিপে উঠে এসেছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট ফর গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বি আইজিডি) যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়, গত বছরের এপ্রিল ও জুনে মাত্র ৩৯ শতাংশ বাড়ির মানুষ সামান্য কিছু সহায়তা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, সবাই সহযোগিতা পাননি। এছাড়াও, যারা যা পেয়েছেন তা খুবই নগণ্য। আয় কমে যাওয়া ও বাইরে থেকে সহায়তা না পাওয়ার পরিস্থিতিতে দরিদ্র মানুষেরা তাদের সঞ্চয় থেকে খরচ করেছে। আয় কমে যাওয়া ও বাসা ভাড়ার বোঝা থেকে বাঁচতে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের অনেকেই শহর থেকে গ্রামে চলে গেছেন। অনেককে কম পুঁজির ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন প্রণোদনা দেওয়া খুবই প্রয়োজন। এই প্রণোদনা বিকল্প প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিতরণ জরুরী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ জানান, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ায় দেশের অর্থনীতি একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অর্থনীতির এই ঘুরে দাঁড়ানো নির্ভর করবে দেশের ছোট-ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে কতোটুকু সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এর ওপর।

সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন আয়োজিত সংলাপে বলা হয়, করোনা ও আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণকৃত সহায়তা পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া এসব সহায়তা নানা কারণে প্রকৃত ভুক্তভোগীদের কাছে সময় মতো পৌঁছে না। এতে অনেক ক্ষেত্রেই অপচয় হচ্ছে। সহায়তা নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে তা জানাতেও পারছেন না ভুক্তভোগীদের অনেকে। সহায়তা বিতরণে ৭ ধরনের সমস্যা এবং এগুলো দূরীকরণে সুপারিশ দেওয়া হয়। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- বরাদ্দ ও বিতরণের অপর্যাপ্ততা, সেবা সম্পর্কিত প্রচার-প্রচারণার অভাব, সুবিধাভোগী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণমূলক না হওয়া, সুবিধাপ্রাপ্তিতে কারিগরি ত্রুটি, তথ্য সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, নির্ধারিত ‘ডাটাবেজ’ না থাকা, ইউনিয়ন পর্যায়ে ত্রাণ সম্পর্কিত অভিযোগ গ্রহণ এবং নিষ্পত্তির কোনো প্রযুক্তিনির্ভর ও কার্যকর ব্যবস্থা না থাকা। সিপিডি এসব সমস্যা সমাধানে কিছু সুপারিশ দিয়েছে। সুপারিশে বলা হয়, করোনা মোকাবিলায় ত্রাণ কর্মসূচির কার্যকারিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বরাদ্দ নির্ধারণে একটি সূচকের ওপর নির্ভর না করে স্থানীয় পর্যায়ের দারিদ্র্যের হার, জনসংখ্যা, বেকারত্বের হার ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে বহুমাত্রিক মাপকাঠি নির্ধারণ করতে হবে। ত্রাণ সেবা সংক্রান্ত প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বাড়াতে হবে। সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বাড়াতে বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণার পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণসহ ত্রাণ কর্মসূচি কার্যকরে আরও পদক্ষেপ প্রয়োজন। এছাড়া ত্রাণ সেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য যেমন উপজেলা ও ইউনিয়নওয়ারী বরাদ্দ, বিতরণ, সুবিধাভোগীদের তালিকা, ‘হটলাইনের’ ব্যবহার, ডাটাবেসে সংরক্ষণ এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে।

সংলাপে সিপিডি জানায়, কভিড-১৯ এর কারণে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে আছেন ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ, যা সর্বশেষ জরিপকৃত শ্রমশক্তির (২০১৬-১৭) প্রায় ২০ দশমিক ১ শতাংশ। সিপিডি (২০২০) প্রাক্কলনে এই মহামারী (উচ্চ) দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশে নিয়ে যাবে। এই ‘নতুন দরিদ্র’র সংখ্যা হতে পারে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ। উপকূলীয় জেলাগুলোতে সাম্প্রতিক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, জনগোষ্ঠীভিত্তিকের চেয়ে দরিদ্রতা ও বিপন্নতাভিত্তিক ত্রাণ তৎপরতা অনেক বেশি কার্যকর হয়। এই কার্যকারিতা নিশ্চিতে আরও তথ্য-উপাত্ত ও প্রশাসনিক সমন্বয় প্রয়োজন। যোগ্য মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিতে প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন।

নিবিড় তদারকির ভিত্তিতে কৃষকের জন্য জামানতবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং কৃষি সহায়তাসমূহ সুষ্ঠুভাবে বিতরণের জন্য মাঠ পর্যায়ে বরাদ্দকৃত সরকারি চাকুরীর নিরীখে কৃষি কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কৃষি ঋণ বিতরণে বর্গা চাষী এবং ত্রাণ বিতরণে গ্রামে ফেরা মানুষের জন্য বিশেষ উদ্যোগের প্রয়োজন আছে।

যারা তালিকাভুক্ত কিন্তু এখনও সহায়তা পাননি তাদের সকলের কাছে দ্রুত নগদ সহায়তা পৌঁছানোর উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি আরো কার্যকর করার ক্ষেত্রে চাহিদা নিরূপণ এবং এর ভিত্তিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে কৃষি প্রণোদনা সম্পর্কে জানানো ও জিও-এনজিও সমন্বয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বি আইডিএস) সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, বি আইডিএসের সিনিয়র রিসার্স ফেলো বলেন, যারা গ্রামে চলে যাচ্ছে তারা যেন সেখানে টিকে থাকতে পারে, তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সরকারের পক্ষে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে বেশি দিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো সম্ভব না, তাই কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের চাহিদামতো প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মাছ চাষের প্রশিক্ষণ, গরু পালনের প্রশিক্ষণ, মুরগির খামার, বিভিন্ন সবজি চাষসহ তাদের চাহিদামতো উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।

https://dailysangram.com/post/442632