২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ৪:৪৮

বিদেশ প্রত্যাগত প্রবাসীদের বিনা জামানত ও বিনা সুদে ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করুন

ড. মো. নূরুল আমিন : প্রবাসী শ্রমিকদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে করোনার কারণে দেশে প্রত্যাগত প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে প্রদত্ত অর্থ পদ্ধতিগত কারণে অবণ্টিতই থেকে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচি কর্তৃক সম্প্রতি পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে প্রবাসী পুনর্বাসনের এই কর্মসূচীটি ব্যর্থ হতে বসেছে। সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে প্রত্যাগত প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবাসী ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্মি, সেলাই এবং অটোরিকশা ড্রাইভিং-এর ন্যায় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে চান। করোনার কারণে চাকরি হারিয়ে তারা খালি হাতে বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ওয়েজ অনার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে শতকরা ৪ টাকা সুদে জনপ্রতি এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দানের জন্য দুই বিলিয়ন টাকা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে প্রদান করে।

বলা বাহুল্য, ওয়েজ অনার্স ফান্ডটি প্রবাসীদের কাছ থেকে আদায়কৃত চাঁদা দিয়েই গঠিত। অর্থাৎ এই তহবিলটি প্রবাসীদের প্রদত্ত তহবিল দিয়ে প্রবাসীদের জন্য গঠিত একটি তহবিল। এতে বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা ছাড়া ব্যাংকের আর কোন দায় নেই। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে যে, বণ্টন ব্যবস্থাপনার কাজটিও তারা করতে পারছে না। দুই বিলিয়নের এই তহবিলটি ছাড়াও সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য পুরুষদের জন্য শতকরা ৯ টাকা ও মহিলাদের জন্য শতকরা ৪ টাকা হারে ঋণদানের জন্য আরও পাঁচ বিলিয়ন টাকার একটি তহবিল সৃষ্টি করেছে। কিন্তু পদ্ধতিগত বিষয়ের উপর ব্যাংক অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করায় ঋণ বণ্টন স্থবির হয়ে পড়েছে।

আবার মহিলা কর্মীদের জন্য নির্ধারিত তহবিলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, চার শতাংশ সুদে মহিলারা ঋণ গ্রহণের আগ্রহী নয়। তারা সুদ মওকুফের দাবি জানাচ্ছেন। আবার ব্যাংক জামানত ছাড়া ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। এ প্রেক্ষিতে জামানত দিয়ে ঋণ নেয়ার মতো প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য বলে জানা গেছে।

বলা বাহুল্য, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিনা জামানতে ঋণ দেয়ার সরকারি নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই নির্দেশনাটি ইতোপূর্বে এসএমই খাতে প্রদত্ত নির্দেশনার সাথে সামঞ্জস্যশীল না হওয়ায় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক তা মানতে দ্বিধা করছে। এসএমই বা Small and Medium Enterprise ঋণ পোর্টফলিও’র কাক্সিক্ষত গঠনে উৎপাদন খাতে অন্যূন ৪০ শতাংশ, সেবা খাতে ২৫ শতাংশ এবং ব্যবসা খাতে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ করার নির্দেশনা ছিল। কটেজ, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খাতে ঋণের সর্বনিম্ন সিলিং ছিল যথাক্রমে ১০,০০০/-, ২০,০০০/- ও ৫০,০০০/- টাকা।

২০১৭ সালে প্রদত্ত নির্দেশনায় ব্যাংক গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে এক বছর মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে তিন মাস, মধ্যম মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৬ মাস গ্রেস পিরিয়ড প্রদানের বিষয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পুনঃঅর্থায়ন, তহবিলের বিপরীতে ঋণ গ্রহীতা, নারী শিল্প উদ্যোক্তা হলে বা ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় কমপক্ষে ৫১ শতাংশ শেয়ার মালিক নারী হলে সে সকল প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তাকে সহায়ক জামানত হিসেবে (Collateral Security) শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গ্যারান্টির বিপরীতে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা প্রদান করতে বলা হয়েছিল।

প্রবাসী শ্রমিক পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় ঋণ প্রার্থীদের বেলায় উপরোক্ত শর্তাবলীর ব্যাপারে কিছু বলা না থাকায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়েছে বলে জানা যায়। অনিশ্চয়তার কারণে ঋণ বিতরণে যে স্থবির অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান প্রয়োজন।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সিংহভাগ প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান। এই বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখে, আমদানি চাহিদা পূরণ করে। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, ওমান, বাহরাইন, ইতালি ও এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি লোক প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে।

২০০৮-০৯ সালে তাদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৯৬৮৯.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১২-১৩ সালে ১৪,৪৬১.২ মিলিয়ন ডলার, ২০১৪-১৫ সালে ১৫,৩১৬.১ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮-১৯ সালে প্রায় ১৬ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলারে তা উন্নীত হয়।

প্রবাসী কর্মীরা অভুক্ত ও অর্ধভুক্ত থেকে দেশের সমৃদ্ধির জন্য অর্থ প্রেরণ করেন। ২০২০ সালে এসে তারা মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হন এবং করোনার কারণে চাকরিহারা হয়ে পথের কাঙ্গালে পরিণত হন। ব্যবসায়িক মন্দার কারণে কর্মস্থলে তারা ছাঁটাই-এর শিকার হন। তাদের অধিকাংশই বেতন-ভাতা পাননি এবং খালি হাতে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। তারা সুদিনে দেশের সেবা করেছেন, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছেন।

তাদের দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানো দেশবাসীর কর্তব্য। কপর্দকহীন অবস্থায় দেশে ফিরে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন শর্ত পূরণ করে পুনর্বাসন ঋণ নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের জন্য নির্ধারিত ঋণ তহবিলের অর্থ প্রকারান্তরে তাদেরই অর্থ, Wage Earners Welfare Fund তাদেরই কাছ থেকে গৃহীত চাঁদা ও শেয়ার দিয়ে গঠিত একটি তহবিল। এই তহবিল গঠনে সরকারের কোন ব্যয় নেই, যাকে Cost of Fund বলা হয়। যেখানে তহবিল সংগ্রহে ব্যয়ের প্রশ্ন আসে, সেখানেই কেবলমাত্র সার্ভিস চার্জ বা সুদের প্রশ্ন তোলা হয়।

প্রবাসী কর্মীদের পুনর্বাসন কর্মসূচিতে যেহেতু এ প্রশ্নটি নেই সেহেতু তাদের বিনা সুদে এবং বিনা জামানতে ঋণ দেয়াই সরকারের উচিত। এতে অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে তাদের দেয়া ঋণ কিছুটা হলেও দেশবাসী শোধ করতে পারবে। আবার ঋণের শর্ত ও ঋণ বিতরণ পদ্ধতিও সহজ করা প্রয়োজন। এতে বেশিসংখ্যক প্রবাসী অংশ নিতে পারবে এবং তাদের অর্থনৈতিক সংকটের লাঘব হবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যত শিগগির উপলব্ধি করেন ততই মঙ্গল।

https://dailysangram.com/post/442528