২৬ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৭:৩৬

ঝিনাইদহে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাধ্যমিকের কার্যক্রম

আগের ৬টিতে সাফল্য নেই, নতুন করে ৩৪টিতে চালু

পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই; রয়েছে শ্রেণিকক্ষের সংকটসহ অবকাঠামোগত অন্যান্য সমস্যা। এ অবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে শিক্ষার্থীরা চলে যাচ্ছে অন্যত্র।
চার বছর আগে ঝিনাইদহের যে ছয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলকভাবে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি চালু করা হয়, সেগুলোর অবস্থা এখন কমবেশি এমনই। সম্প্রতি তিনটি বিদ্যালয়ে গিয়ে এই পরিস্থিতির সত্যতা পাওয়া গেছে। অথচ গত বছর জেলার আরও ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একই কার্যক্রম চালু করা হয়। বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর সফলতা নিয়ে সন্দিহান।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঝিনাইদহের ছয়টি উপজেলার ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েক ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি দেয়। তবে প্রথম বছরে কেবল ষষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে সদর উপজেলার ফুরসন্ধী, কালীগঞ্জের দামোদরপুর, কোটচাঁদপুরের লক্ষ্মীকুণ্ডু, মহেশপুরের কুশাডাঙ্গা, শৈলকুপার কবিরপুর ও হরিণাকুণ্ডুর কাপাশহাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
কালীগঞ্জের দামোদরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ষষ্ঠ শ্রেণিতে সাতজন ক্লাস করছে। শিক্ষক সুমন বিশ্বাস ক্লাস নিচ্ছেন। চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে ভাগ করা কক্ষের আরেক পাশে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির চারজন অপেক্ষা করছে।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রকিব উদ্দিন বলেন, শ্রেণিকক্ষের সংকটের কারণে মাঝখানে বেড়া দিয়ে দুটি কক্ষ বানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে প্রথমবার এই স্কুলে ২৭ জন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের সংকটের কারণে ঠিকমতো তাদের ক্লাস নেওয়া যায়নি। তাই পরে অনেকই অন্যত্র চলে গেছে।
২০১৪ সালেও এই বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২৭ জন ভর্তি হয়েছিল। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেটা নেমে আসে ৯ জনে। অথচ এই বিদ্যালয়ে প্রতিবছরই পঞ্চম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা থাকে ৪৫-৫০ জন। শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষের সংকট দেখে তারা পার্শ্ববর্তী মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে চলে যায়।
বর্তমানে দামোদরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে নয়জনের পাশাপাশি অষ্টমে মাত্র দুজন ভর্তি আছে। আর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত তিনটি শ্রেণির সব ক্লাস নিতে হচ্ছে একজন শিক্ষককে।
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, এখন মোট আটটি শ্রেণির ২৩২ জন শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক আছেন মাত্র পাঁচজন। তার মধ্যে আবার একজন ডেপুটেশন নিয়ে দীর্ঘদিন অন্যত্র চাকরি করছেন। ফলে এখন চারজনকে এতগুলো শ্রেণির পাঠদান সামলাতে হচ্ছে। কমপক্ষে আটজন শিক্ষক ও ছয়টি শ্রেণিকক্ষ থাকলে সব শ্রেণির ক্লাস চালিয়ে নেওয়া যেত বলে উল্লেখ করেন প্রধান শিক্ষক রকিব উদ্দিন।
কালীগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সালমা খাতুন বলেন, দামোদরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়টি উপজেলার এক প্রান্তে হওয়ায় শিক্ষকেরা সেখানে থাকতে চান না। তাঁরা রাজনৈতিক তদবিরে অন্যত্র চলে যান। এ কারণে ওই স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ে ঠিকমতো শিক্ষার্থী থাকছে না। প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প (পিডিপি-৩) আওতায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ভবন নির্মাণ করা হবে। তখন শ্রেণিকক্ষের সংকট থাকবে না।
হরিণাকুণ্ডুর কাপাশহাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল সমস্যা শ্রেণিকক্ষের সংকট। এখানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ৩৪২ জন। একসঙ্গে চালাতে হয় সাতটি ক্লাস, কিন্তু শ্রেণিকক্ষ আছে ছয়টি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, এ ছয়টি শ্রেণিকক্ষের মধ্যে আবার তিনটি পুরোনো টিনশেডের। সামান্য বৃষ্টি হলে সেখানে ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না।
তবে এই বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর কমতি নেই। এ বছর এখানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে ৩১ জন। ২০১৩ সালে প্রথমবার ৩৭ জন ভর্তি হয়েছিল। পরের বছর ৪৫ জন এবং ২০১৫ সালে ৩২ জন ভর্তি হয়। বর্তমানে সপ্তম শ্রেণিতে ২৪ জন আর অষ্টম শ্রেণিতে ৪১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
প্রধান শিক্ষক বলেন, এখানে বর্তমানে ১০ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। তাই শ্রেণিকক্ষের সংকট থাকলেও বিকল্প উপায়ে পাঠদান চালিয়ে নিতে পারছেন তাঁরা। এ কারণে শিক্ষার্থীর অভাব হচ্ছে না।
কোটচাঁদপুর উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও মূল সমস্যার নাম অবকাঠামো। এখানে আটটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থী আছে মোট ৫৫৯ জন, কিন্তু শ্রেণিকক্ষ আছে মাত্র নয়টি। শিক্ষার্থী অনুপাতে এখানে অন্তত ১২টি কক্ষ থাকার দরকার বলে মনে করছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শ্রেণিকক্ষের সংকটের পাশাপাশি এখানে মেয়েদের জন্য পৃথক শৌচাগার ও কমনরুম নেই। অথচ এই বয়সে এগুলো তাদের সবচেয়ে বেশি জরুরি।
এমন অবস্থার মধ্যেই ২০১৬ সালে ঝিনাইদহের আরও ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাধ্যমিকের তিনটি শ্রেণির কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় সাতটি, কালীগঞ্জে সাতটি, কোটচাঁদপুরে চারটি, মহেশপুরে সাতটি, শৈলকুপায় নয়টি এবং হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় ছয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
এসব বিদ্যালয়ের একটি হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হামিরহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মো. আনছার আলী বলেন, এখানে ছয়টি শ্রেণিকক্ষের কাজ এখন চারটি কক্ষে সারতে হচ্ছে। পরের বছর সপ্তম শ্রেণি চালু হলে অবস্থা আরও খারাপ হবে। তা ছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০১৩ সালে মাধ্যমিকের কার্যক্রম চালু হওয়া ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এখনো পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারেনি। চার বছর গেলেও তাদের শিক্ষক ও অবকাঠামোগত সংকট দূর করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে জেলার আরও ৩৪টি প্রতিষ্ঠানে এই কার্যক্রম চালুর বিষয়টি সফল হবে কি না, সে বিষয়ে তাঁরা সন্দিহান।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকের সংকট এখন অনেকটা কমে এসেছে। অল্প দিনের মধ্যে তা আরও কমে যাবে। আর সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোগত সমস্যার বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1120102/