১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১১:০৪

রমযানকে সামনে রেখে নিত্য পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট সক্রিয়

এইচ এম আকতার : নানা পদক্ষেপেও নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। রমযানকে সামনে রেখে এবার নিত্যপন্যের বাজারে সক্রিয় হয়ে উঠছে সিন্ডিকেট। প্রথমে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে, পরে তাদের সঙ্গেই আলোচনায় বসে দাম নির্ধারণ করেন। এতে সমালোচনায় বসে দাম কমে সামান্য। আমদানি করা সত্ত্বেও এখন উর্ধ্বমুখী চালের বাজার। খোলা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ছেই। কোন কারণ ছাড়াই বাড়ছে চিনির দাম। একইভাবে বাড়ছে আটার দামও।

প্রতি বছরই রমযান এলে নিত্য পণ্যের দাম কোন কারণ ছাড়াই বাড়ে। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের সাথে দফায় দফায় মিটিং করতেই শেষ হয়ে যায় রমযান। সরকার ব্যবসায়ীদের আর ব্যবসায়ীরা সরকারকে দায়ী করেন। সরকারের কোন উদ্যোগই এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

জানা গেছে, রমযান এলে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে বেশ কয়েকটি মনিটরিং কমিটি করে থাকে। বাজারে ভেজাল বিরোধী অভিযান ছাড়া আর কোন তৎপরতা চোখে পড়ে না। এতে করে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কোন কারণ ছাড়াই দাম বাড়তে থাকেন। ভোক্তাদের অভিযোগ যদি সব কয়টি কমিটি বাজারে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতো তাহলে সিন্ডিকেট চক্র নিজেদের ইচ্ছা মত দাম বাড়াতে পারতো না।

দর বৃদ্ধিতে লাগাম টানতে ভারত থেকে আমদানি করা চাল একসপ্তাহ ধরে বাজারে থাকলেও তাতে দামে তেমন হেরফের হয়নি বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। আমদানির উদ্যোগ নেয়ার একমাস পার হতে চললেও চালেও দাম কমানোতে তার কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা।

কারওয়ান বাজারে একাধিক খুচরা বিক্রেতা জানান, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন কোম্পানির ভারতীয় মিনিকেট ও আটাশ চাল বাজারে এসেছে। তবে দাম দেশীয় মিলের মতোই। সেকারণে ভারতীয় চালে ক্রেতার আগ্রহ কম।

কারওয়ান বাজার রেললাইন গলিতে কিশোরগঞ্জ রাইস এজেন্সির একজন বিক্রয়কর্মী বলেন, দেশীয় মিনিকেট প্রতি বস্তা তিন হাজার টাকা। আর ভারতীয় মিনিকেট প্রতি বস্তা ২৯০০ টাকা। দামে পার্থক্য খুবই কম। সেকারণে ভারতীয় চাল খুব একটা চলছে না। গত সপ্তাহের শুরুতে এক চালানে যে চাল এসেছিল তা এখনও রয়েছে বলে জানান এই বিক্রেতা।

রেললাইনের পাশের এই চালের দোকানগুলো প্রশস্ত রাস্তার পাশে হওয়ায় খুচরা ও পাইকারি দুই ধরনের বেচাকেনাই এখানে হচ্ছে। বেশ কয়েকটি মিনি ট্রাকে চাল ওঠানামা দেখা গেলেও সেখানে ছিল না কোনো আমদানি করা চাল। কারওয়ান বাজারে এদিন মিনিকেট ৬০ টাকা, নাজির ৬২ টাকা, বি আরআটাশ ৪৬ টাকা, পাইজাম ৪৫ টাকা, স্বর্ণা ৪০ টাকা, জিরা শাইল ৫২ টাকায় প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছিল।

ভোজ্যতেলের পর এবার বাজারে বাড়ছে চিনির দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম বেড়ে ৬৬ থেকে ৬৮ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অবশ্য অনেক দোকানে এখনো আগে কেনা চিনি ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

চালের পাইকারি বাজারে আমদানির খবরের সামান্য প্রভাব পড়েছে। দাম কমেছে কেজিপ্রতি এক থেকে দুই টাকা। তবে খুচরায় প্রভাব নেই। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, খুচরা দোকানে চিনি বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৭০ টাকা দরে, যা এক সপ্তাহ আগে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা ছিল।

পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে কোম্পানিগুলো চিনির বাড়তি দাম চাইছে। এ কারণে পাইকারি বাজারও বাড়তি।

কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চিনি ৩ হাজার ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়, প্রতি কেজি সাড়ে ৬৩ টাকার মতো। দেশে পাঁচ থেকে ছয়টি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানি করে পরিশোধনের পর বাজারে ছাড়ে। খোলা চিনি গেল সপ্তাহে ৬৫/৬৮ টাকা দরে বিক্রি হলেও, প্যাকেটজাতো চিনির দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭৫/৭৮ টাকা কেজি। তবে কোন কোন দোকানে পুরানো স্টকের প্যাকেট চিনি মিলছে ৭০ টাকা কেজিতে। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে কয়েক মাস ধরে কোম্পানিগুলো ভোজ্যতেলের দামও বাড়িয়েছে।

ঢাকার তিনটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি খোলা সয়াবিন ১২০-১২৫ টাকা, পাম তেল ১১০-১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেলের প্রতি লিটারের দাম ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। মিরপুর শাহ আলী মার্কেটের ব্যবসায়ী রাসেল খান বলেন, তেলের বোতলের গায়ে লেখা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ৬১৫ থেকে ৬২৫ টাকা। বড় বাজারে বিক্রেতারা কমিয়ে বিক্রি করেন। পাড়ামহল্লার এ ছাড় পাওয়া যায় না।

সরকার চলতি মাসে বেসরকারি খাতে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিলেও বাজারে তেমন একটা প্রভাব নেই। অনুমতি পেয়ে ব্যবসায়ীরা কিছু কিছু চাল ইতিমধ্যে ভারত থেকে দেশে এনেছেন। এ খবরে পাইকারি কিছু কিছু চালের দাম কেজিপ্রতি এক থেকে দুই টাকা কমেছে।

ঢাকার বাবুবাজারের চালের আড়ত শিল্পী রাইস এজেন্সির মালিক কাওসার রহমান বলেন, আমদানিতে চালের দাম কমবে, এই আশঙ্কায় বেচাকেনা কমে গেছে। ফলে দাম সামান্য কমেছে। এখন ভারতীয় চাল এলে পরিস্থিতি বোঝা যাবে।

মিরপুর শাহ আলী মার্কেটের চালের আড়তদার মো. হাসান মিয়াও দাম কিছুটা কমার কথা জানান। তিনি বলেন, পাইকারিতে এক বস্তা চাল (৫০ কেজি) ৫০-৬০ টাকা কমে বিক্রি করা হচ্ছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হলের ডিএনসিসি কাঁচাবাজার, মিরপুর শাহ আলী মার্কেট ও কারওয়ান বাজারে ঘুরে দেখা যায়, বাজারে সরু মিনিকেট চাল ৬২ থেকে ৬৫ টাকা, নাজিরশাইল ৬০ থেকে ৬২ টাকা, বি আর-২৮ চাল ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা এবং মোটা গুটি স্বর্ণা চাল মানভেদে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়।

খুচরায় সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১২৪ টাকা কেজি। বেড়েছে প্যাকেটজাত চিনির দামও। বাজারে প্রভাব নেই আমদানি করা চালের। চাল বিক্রি হচ্ছে আগের বাড়তি দরেই। কয়েক দিনের ব্যবধানে আবারো বাড়লো খোলা সয়াবিন তেলের দাম। ভালো মানের খোলা সয়াবিন খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১২৪ টাকা কেজি। যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ১২০ টাকা।

খুচরা বাজারে খুব বেশি হেরফের নেই চালে। ভালো মানের মিনিকেট ৬৫ আর নাজিরশাইল ৬৮/৭০ টাকা কেজি। দাম কমেনি মোটা চালেরও। বি আর আটাশ ৫৪/৫৫ আর গুটি চাল খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে আমদানি করা চাল পাচ্ছেন না তারা। কম দামের চাল পাইকারিতে সহজলভ্য না হলে খুচরায় দাম কমবে না বলেও জানালেন খুচরা বিক্রেতারা।
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে শান্তিবাগের বাসিন্দা রিপন জানান, বাজারে গিয়ে জিনিসপত্রে দাম শুনলে মাথা ঘুরে।

বাজারে যেটার চাহিদা যেমন সেটার দামও তেমন চড়া। এটাতো কোনো সিস্টেম হতে পারে না। কোনো পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি থাকলে দাম বাড়তে পারে। কিন্তু সরবরাহে ঘাটতি নেই অথচ চাহিদা বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছেন। সরকার দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পরও কমানো হয়নি। তাদের শক্তির উৎস কোথায়? তারা তো সরকারের নির্দেশ অমান্য করছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন? তারা ইচ্ছেমতো সবকিছুর দাম বাড়ায়। সরকারের যথাযথ মনিটরিং না থাকায় বাজারে এমন অস্থিরতা বলে মনে করেন তিনি।

https://dailysangram.com/post/442388