৩১ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১০:০০

ডিএনসিসির বিষফোড়া সাতাশ মার্কেট

২২টি ঝুঁকিপূর্ণ, ১টি বেদখল, হারিয়ে গেছে ২টি, ২টিতে ওয়ার্কশপ ও কোভিড-১৯ পরীক্ষাগার - ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ছয়তলা মার্কেট এখন পরিত্যক্ত

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নিজেদের ৪৩টি মার্কেটের মধ্যে ২৭টি মার্কেট নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে। এর মধ্যে একটি বেদখল হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে দুটি, ২২টি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ, একটিতে মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ এবং আরেকটিতে কোভিড-১৯ পরীক্ষাগার করা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে মার্কেটগুলো নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

ডিএনসিসির এসব মার্কেটে মোট দোকান ১৩ হাজার ৭৮৬টি। অনেক ক্ষেত্রে দোকান গ্রহীতারাও বিপাকে পড়েছেন। ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে কয়েকটি মার্কেটে নকশাবহির্ভূত দোকানও নির্মাণ করেছে প্রভাবশালী মহল। এসব দোকান থেকে রাজস্বও পাচ্ছে না ডিএনসিসি।

এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা যুগান্তরকে বলেন, ‘ডিএনসিসির ঝুঁকিপূর্ণসহ অন্য মার্কেটগুলো নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ সাতটি মার্কেট ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া কাওরান বাজারকে গাবতলী ও যাত্রাবাড়ী স্থানান্তর করা হবে। সে ক্ষেত্রে মহাখালী মার্কেটের ভিন্ন ব্যবহারের চিন্তা করছে ডিএনসিসি।’

তিনি বলেন, ‘ডিএনসিসির সব মার্কেট সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার লক্ষ্যে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দফায় দফায় সভা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গুলশান মার্কেটের আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ‘সিটি বন্ড’ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এভাবে ধাপে ধাপে সব মার্কেট সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হবে।’

বেদখল বাউনিয়া বাঁধ মার্কেট : মিরপুর বাউনিয়া বাঁধে ঈদগাহ মাঠসংলগ্ন একটি মার্কেট ছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)। প্রায় চার বিঘা জমির ওপর সেমিপাকা ৩৭৪টি দোকান ছিল। ওই জমির আনুমানিক বাজারমূল্য ৪০ কোটি টাকা। সেখানে শতাধিক অবৈধ দোকানপাট এবং অন্তত ৩০০টি বস্তিঘর রয়েছে।

এসব দোকান ও ঘর থেকে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ভাড়া-বাণিজ্য করছেন। দীর্ঘদিন ধরে এমন অবস্থা চললেও এ ব্যাপারে নির্বিকার কর্তৃপক্ষ। সরেজমিন দেখা গেছে, ওই ঈদগাহ মাঠসংলগ্ন ডিএনসিসির ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুর রউফ নান্নুর কাউন্সিলর কার্যালয়। এলাকাবাসীর প্রশ্ন কাউন্সিলর অফিসের এত কাছে ডিএনসিসির মূল্যবান এ সম্পদ বেদখল হলেও তিনি নির্বিকার কেন? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাউন্সিলর নান্নু যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বেদখল মার্কেট উদ্ধারের ব্যাপারে ডিএনসিসি মেয়রের সঙ্গে কথা হয়েছে। মেয়র এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। আশা করি শিগগিরই মার্কেটটি দখলমুক্ত করে আমরা বহুতল বিশিষ্ট মার্কেট নির্মাণ করতে পারব।’

হারিয়ে যাওয়া দুটি মার্কেট : নাখাল পাড়া কাঁচা মার্কেট নামে ডিএনসিসির একটি মার্কেট ছিল। দীর্ঘদিন ডিএনসিসি (ডিসিসি) ওই মার্কেট পরিচালনা করে। এখনো মার্কেটটি বহাল রয়েছে। কিন্তু, সেখানে ডিএনসিসির কোনো কর্তৃত্ব নেই। ওই মার্কেটের দোকানদাররা নিজেদের মালিক দাবি করছেন। এর স্বপক্ষে তারা কাগজপত্রও তৈরি করে ফেলেছেন। প্রায় ১০০ শতাংশ এ কাঁচাবাজারের ওপর ডিএনসিসির এখন কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগ থেকে এ ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এটা নিয়ে মামলা চলমান বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে নাখাল পাড়া কাঁচা মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘এ জায়গা ব্যক্তি মালিকানাধীন। ১৯৭৯ সালে সিটি করপোরেশন এ মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নেয়। কিন্তু পরে একপর্যায়ে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।’

এদিকে বটতলা (বেগুনবাড়ী) বেগুনবাড়ী কাঁচা টোলা মার্কেট নামে একটি মার্কেট ডিএনসিসি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে। ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগের তালিকায় এমন তথ্য রয়েছে। কিন্তু সে জায়গায় কী করা হয়েছে, এ ব্যাপারে কোনো তথ্য সরবরাহ করা হয়নি। রাজস্ব বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হলেও তারা তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল হামিদ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তিনি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না।’

ঝুঁকিপূর্ণ ২২ মার্কেট : মিরপুর-১ নম্বর হযরত শাহ আলী (রহ.) সুপার মার্কেটের জায়গার পরিমাণ প্রায় ৬ বিঘা। এ জায়গার অংশবিশেষ নিয়ে চারতলাবিশিষ্ট মার্কেট নির্মাণ করেছে ডিএনসিসি। ওই মার্কেট ব্যবসায়ীদের বরাদ্দ দিলেও সেখানে নিচতলা ছাড়া অন্যান্য তলা খালি পড়ে আছে। আর পাশের পুরাতন মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে জমজমাট ব্যবসা চলছে। সরেজমিন দেখা গেছে, ডিএনসিসি পুরোনো ভবনটি মূল স্ট্রাকচার থেকে সরে গেছে। যেকোনো সময় এ ভবন ধসে ভয়াবহ প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।

ব্যবসায়ীরা জানান, ২০০০ সালে ওই মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। এরপর কচ্ছপ গতিতে চলছে কার্যক্রম। ডিএনসিসির ওই জায়গা ঘিরে ১৭টি সমিতির তিন হাজার ৫০০ জনের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে। এসব গ্রাহক আবেদন জানালেও অবশিষ্ট জায়গায় ভবন নির্মাণ করছে না। ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা দ্রুত বিদ্যমান সমস্যার সমাধান চান।

মিরপুর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি কাজী রায়হান তপন যুগান্তরকে বলেন, ‘মার্কেট নির্মাণের ক্ষেত্রে বাধা থাকে ব্যবসায়ীরা জায়গা ছাড়তে চান না। এখানে সেটা নেই। আমরা ডিএনসিসিকে বলছি তারা যেন দ্রুত মার্কেট নির্মাণ কাজ শুরু করে। কিন্তু, ডিএনসিসি সেটা করছে না।’

মহানগরীর রায়ের বাজার কাঁচাবাজারকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে ডিএনসিসি। এরপর ওই মার্কেটের ঝুঁকিপূর্ণ ছাদ অপসারণ করা হয়েছে। ওই মার্কেটের ৯৭৫টি দোকানদার এখন নিচে বসে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তারা টিনের ছাদ দিয়ে নিয়েছেন। মূল্যবান জায়গায় ব্যবসায়ীরা ব্যবসা পরিচালনা করলেও ডিএনসিসি কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না। একই সঙ্গে নতুন করে ওই ভবন নির্মাণেরও কোনো তৎপরতা নেই। ডিএনসিসি সূত্রে জানা যায়, রায়ের বাজার বিদ্যমান মার্কেট ভেঙে বহুতলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করার লক্ষ্যে একটি চুক্তি করা হয়েছিল। অসম চুক্তি করায় সেটা নিয়ে টানাপড়েনের কারণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। বুধবার ওই মার্কেটে সবজির দোকানদার মফিজ, আমজাদ ও মনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা চাই শিগগিরই এ মার্কেটের ভবন নির্মাণ কাজ শুরু হোক। কিন্তু ডিএনসিসির কোনো তৎপরতা লক্ষ করছি না।

মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের প্যারিস রোড সংলগ্ন নিউ ডিএনসিসি মার্কেট। প্রায় ২৫ বছর আগে মার্কেটটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে দুই হাজার ৩৬৩টি দোকানও বরাদ্দ দেয় তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। এরপর সরকার পরিবর্তন, মেয়র বদল, সিটি করপোরেশন বিভক্তির কারণে ওই মার্কেটের বাকি কাজ শেষ হয়নি। সে সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খালেক এন্টারপ্রাইজ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পালিয়ে যায়। বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে ওই মার্কেটটির চিত্র খুবই করুণ। দেওয়ালে শ্যাওলা জমেছে। খসে পড়ছে পলেস্তারা। দুই একর জমির ওপর ছয়তলাবিশিষ্ট ভবনটিতে এখন ভূতুড়ে পরিবেশ। অথচ এ অবকাঠামো নির্মাণে ডিএনসিসির খরচ হয়েছে অন্তত ২৫ কোটি টাকা। ওই জমির বাজারমূল্য শত কোটি টাকার বেশি বলে এলাকাবাসীর অভিমত।

এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক যুগান্তরকে বলেন, ‘এ মার্কেটটির খুবই খারাপ অবস্থা। এ অবস্থায় এ মার্কেটটি সংস্কার করে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এ কারণে আমি মেয়রকে বলেছি, এ মার্কেটটি ভেঙে আধুনিক মানের একটি মার্কেট নির্মাণ করতে। এ বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে।’

মোহাম্মদপুর টাউন হল মিলনায়তন কাম শপিং কমপ্লেক্স মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ডিএনসিসি। এ মার্কেটে ৮৯টি দোকান বরাদ্দ দেওয়া আছে ডিএনসিসির। সেগুলো বহালতবিয়তে চলছে। এ ছাড়া গুলশান-১ উত্তর পাকা মার্কেট, গুলশান-২ উত্তর কাঁচা মার্কেট, গুলশান-১ পাকা মার্কেট, গুলশান-১ কাঁচা মার্কেট, গাবতলী প্রান্তিক সুপার মার্কেট, মোহাম্মদপুর কাঁচা বাজার, মোহাম্মদপুর রিং রোড টিনশেড মার্কেট, মোহাম্মদপুর রিং রোড পাকা মার্কেট, কাওরান বাজার ১ নম্বর ভবন মার্কেট, কাওরান বাজার মুরগি শেড, কাওরান বাজার মৎস্য আড়ৎ, কাওরান বাজার কর্মকার শেড, কাওরান বাজার কাঁচা মার্কেট, কাওরান বাজার কাঁচা মালের আড়ৎ, কাওরান বাজার কাঁচা মার্কেটের চতুর্দিকের মার্কেট, ফার্মগেট কলমিলতা কাঁচা মার্কেটও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব মার্কেটে তিন হাজার ৫১৫টি দোকান রয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের জটলা থাকে এসব দোকান ঘিরে। যেকোনো সময় ঝুঁকিপূর্ণ এসব মার্কেটে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

দুই মার্কেটের ভিন্ন ব্যবহার : রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র থেকে কাওরান বাজার সরিয়ে নিতে তিনটি মার্কেট নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ সিদ্ধান্তের আলোকে যাত্রাবাড়ী, আমিন বাজার ও মহাখালীতে পৃথক তিনটি মার্কেট নির্মাণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল এ তিন মার্কেটে কাওরান বাজারের ব্যবসায়ীদের সরিয়ে নেওয়া। এর মধ্যে মহাখালী ও আমিন বাজার মার্কেট ডিএনসিসির আওতাভুক্ত। বর্তমানে মহাখালীর মার্কেট কোভিড-১৯ এর ল্যাবরেটরি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ডিএনসিসি মেয়র ভবনটি হাসপাতালে রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছেন। এ মার্কেটে এক হাজার ১৭৮টি দোকান রয়েছে। ইতোমধ্যে ৫২টি বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে আমিন বাজারে বিশালায়তনের মার্কেটকে ওয়ার্কশপ, অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টে রূপান্তরিত করেছে ডিএনসিসি। এ মার্কেটের দোকান সংখ্যা ৬৯৭টি। সব দোকান বরাদ্দ দিলেও একজন ব্যবসায়ীকেও সেখানে স্থানান্তর করা যায়নি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/389231/