৩০ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১১:১৯

বিষ রহস্য (১)

গুল-মবিলে ‘সাপের বিষ’

দেড় দশকে দেড় হাজার কোটি টাকার বিষ উদ্ধারের খবর, প্রায় সবই নকল * এত বিষের জন্য প্রয়োজনীয় সাপ খামারে নেই -অধ্যাপক আবু রেজা - গ্রেফতার হন বাহক ও ক্রেতা, বিক্রেতা অধরা

গবেষণা ছাড়া দেশে সাপের বিষের কোনো ব্যবহার নেই। এ বিষ উৎপাদন, বেচাকেনা বা লেনদেনেরও নেই বৈধতা। কাজেই সুযোগ নেই রপ্তানির। দেশে সাপের বিষের তেমন বাজারও নেই।

এরপরও প্রতি বছর কয়েকশ কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধারের খবর জানাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে সেটি বিষ নয়।

মবিল, তামাকজাত গুল, রেজিন, চক পাউডার, জিঙ্ক ডাস্ট, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি পণ্যকে সাপের বিষ বলে চালিয়ে দিচ্ছে প্রতারক চক্রগুলো।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, দেশে অন্তত সাতটি চক্র সাপের বিষ বিক্রির নামে প্রতারণা করে যাচ্ছে। ভেজাল বিষ তৈরি ও বিক্রির পাঁচ ধাপে যুক্ত রয়েছে শতাধিক প্রতারক।

উচ্চবিত্তদের টার্গেট করে ফাঁদে ফেলে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। আর এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাহক ও ক্রেতারাই গ্রেফতার হচ্ছেন। বিক্রেতা বা চক্রের হোতারা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

‘কেউ জানে না কারও ঠিকানা’ পদ্ধতিতে চক্রগুলো এ অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পৌঁছাতে পারছে না চক্রের গোড়ায়।

পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির অভিযানে দেড় দশকে দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যের বিষ উদ্ধারের কথা জানানো হয়েছে।

র‌্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, এ মূল্য আটক ব্যক্তিদের দেওয়া হিসাব, প্রকৃত মূল্য নয়। সূত্রমতে, ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ কার্যক্রম শুরুর পর শুধু র‌্যাবই বিভিন্ন সময়ে ৮৫০ কোটি টাকার বিষ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে।

১৭ অভিযানে ৭৩ জনকে গ্রেফতার করে বাহিনীটি। উদ্ধার করে ১২০ পাউন্ড বিষ ও ১৮টি জার। সর্বশেষ ১৭ জানুয়ারি ৭০ কোটি টাকার বিষসহ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে দুজনকে আটকের খবর জানায় র‌্যাব।

বিষ উদ্ধারের এ পরিমাণকে অস্বাভাবিক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তরের উপ-পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. শেফাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, ‘সাপের খামার বা সাপ থেকে বিষ উৎপাদানের কোনো অনুমোদন নেই। এটি অবৈধ।’

এ বিষ রপ্তানি নিষিদ্ধ বলে জানায় আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এসএম আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, দেশে ওষুধ তৈরিতেও এ বিষের ব্যবহার হয় না।

সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. আবু রেজা।

তিনি বলেন, একবার যদি একটা সাপ মিল্কিং (বিষ বের করার পদ্ধতি) করা হয় সেখান থেকে খুব বেশি হলে ২০০ মাইক্রো লিটার বিষ পাওয়া যায়।

সেটাকে যখন ড্রাই করা হয় তখন খুব বেশি হলে ৫০-৬০ মিলিগ্রাম বিষ পাওয়া যাবে। যা বলা হচ্ছে এ পরিমাণ বিষ সংগ্রহ করা বা আহরণ করার জন্য যে পরিমাণ সাপ দরকার সেটা কিন্তু কোনো খামারে নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যেসব সাপের বিষের কথা শুনি সেগুলোর বেশিরভাগই ভুয়া। বলা হয়, এগুলো বাংলাদেশে উৎপাদন হয় না, দূরপ্রাচ্য থেকে আনে। যেমন- কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড। কিন্তু আমি যাচাই করেছি এসব দেশে কোথাও এমন বিষ উৎপাদন হয় না, চীনেও না।’

এ নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চক্রগুলো পাঁচ ধাপে নকল বিষ প্রস্তুত ও বিক্রি করে থাকে। প্রথমে তারা সহজলভ্য দেশীয় কিছু উপাদান কিনে তা মিশিয়ে নকল বিষ তৈরি করে।

পরে নকল বিষ রাখার জন্য দেখতে আকর্ষণীয় জার ও ক্যাটালগসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে। বিষ রাখার পাত্র তৈরিতে ব্যবহার হয় উন্নতমানের চামড়া। তৃতীয় ধাপে একটি পক্ষ বিক্রির জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করে।

এক্ষেত্রে চোখ থাকে অলস টাকা পড়ে আছে এমন উচ্চবিত্তদের। চতুর্থ ধাপে বৈঠকে ঠিক হয় দরদাম, ক্রেতাকে দেওয়া হয় ‘স্যাম্পল’ (নমুনা)। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বড় কর্মকর্তা পরিচয় দিয়েও অনেককে বৈঠকে রাখা হয়। পঞ্চম ধাপে বিক্রি হয় নকল সাপের বিষ।

যেভাবে তৈরি হয় নকল বিষ : ঢাকার সাভারে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় চক্রের কয়েক সদস্যের সঙ্গে। তারা ভেজাল বিষ তৈরির প্রক্রিয়াটি দেখান। যেখানে গুল ও মবিল দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করেন তারা।

এগুলোকেই সাপের বিষ বলে চালিয়ে দেন। আর ভুয়া দানাদার বিষ তৈরি সম্পর্কে জানান, ক্রিস্টাল সদৃশ কাচের জার ও বেগুনি রঙের এক ধরনের দানাদার জাতীয় পদার্থের ব্যবহার করেন।

অন্য একটি চক্র রেজিন (লাইলনের সুতা তৈরিতে ব্যবহার হয়), চক পাউডার ও জিঙ্ক ডাস্ট (দেয়াল বা ফার্নিচার রং করার আগে সাধারণত যে সাদা জিনিসের প্রলেপ দেয়া হয়) দিয়েও বিষ তৈরির কথা জানায়।

চক্রের সদস্যদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বিষ উদ্ধারসংক্রান্ত সাতটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে যুগান্তর। এতে দেখা যায়, উদ্ধার করা বিষের সঙ্গে চক্রের সদস্যদের বর্ণনা পুরোপুরি মিলে যায়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের সহকারী রাসায়নিক পরীক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম সরকার ৭ বছর র‌্যাবের ফরেনসিক ল্যাবের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমার সময়ে ৯টি নমুনা পরীক্ষা করেছি। এর ৭টিই ভুয়া। আর দুটি স্যাম্পল প্রকৃত বিষ হলেও তার পরিমাণ ছিল সামান্য। মানে ছোট ভাইল (ইনজেকশন সিরিঞ্জের মতো)।

তিনি বলেন, পরীক্ষা করে দেখেছি সাপের বিষ বলা হলেও এগুলো তৈরি হয়েছে মবিল, গুলসহ বিভিন্ন পদার্থ দিয়ে।

চক্রের সদস্যদের বর্ণনায় উঠে আসা বেগুনির রঙের দানাদার পদার্থের কথা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো মূলত পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট (জীবাণুনাশক)। এটিকেই তারা কোবরা সাপের দানাদার বিষ বলে চালিয়ে দেয়।

সাত চক্রের ভেলকি : অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীতে সবচেয়ে আলোচিত নাম আসলাম। যিনি পুলিশের এক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শকের ভাগিনা পরিচয়ে চলেন।

রাজনৈতিক ও পেশাগতভাবে ‘প্রভাবশালী’ বিভিন্নজনের সঙ্গে সুদর্শন এ ব্যক্তির ‘ওঠাবসা’ রয়েছে। প্রতারণায় বিভিন্ন পক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করতে তাদের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন ছবিও ব্যবহার করে তার নেতৃত্বাধীন চক্রটি।

গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার পাশাপাশি মিরপুর, উত্তরা, নিকেতন এলাকায় তাদের কার্যক্রম চলে। চক্রে আলমগীর, ইকবাল, রহমান, মুহিত, মনির, তপুসহ বেশ কয়েকজন রয়েছেন। রয়েছেন নারী সদস্যও।

ঢাকার বাইরের কয়েকটি চক্রের সঙ্গেও এদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। ময়মনসিংহ, জামালপুর, গাজীপুর অঞ্চলে মামুন ও মাসুদ সাপের বিষ প্রতারণায় যুক্ত।

বরিশাল, ঝালকাঠি পিরোজপুর অঞ্চলে প্রতারণায় যুক্ত খলিল, সুমন, রহমত ও মামুন। রংপুর, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলে আমিন, রফিক ও আসমা- এ তিন নাম পাওয়া গেছে।

সিলেট অঞ্চলে মালেক, রফিক ও নান্নু এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ প্রতারণায় হোসেন ও জাহিদ নামের দুজন যুক্ত। অনুসন্ধানে এ চক্রের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যের ঘনিষ্ঠতার কথাও জানা গেছে।

এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ‘এখানে তাদের মূল ব্যবসা ‘সোর্স মানি’। কারণ ভেজাল বিষ আসল ডিক্লেয়ার (ঘোষণা) করলে পার্টির (প্রতারক চক্র) কাছ থেকে তারা টাকা পাবে। এটা কেউ জানবে না। অন্যদিকে সরকারের কাছ থেকে পাবে ‘সোর্স মানি’। দুই দিকেই ইনকাম।’

গ্রেফতার হন ক্রেতা, বিক্রেতা অধরা : ১০টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ক্রেতা বা বাহক গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের অনেকের রিমান্ডও হয়েছে।

কিন্তু বিষ কার কাছ থেকে এসেছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারছেন না। ফলে শেকড় তুলে ফেলতে না পারায় থামানো যাচ্ছে না এ প্রতারক চক্রকে।

আবার অভিযানে যাদের ধরা হচ্ছে তা নিয়েও রয়েছে রহস্য। একটি সূত্র বলছে, ভেজাল বিষ কিনে প্রতারণার শিকার ব্যক্তি যাতে এ নিয়ে কথা বলতে না পারেন সেজন্য চক্রের সদস্যরাই নানাভাবে তাদের গ্রেফতারে সহযোগিতা করেন।

আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যেন বিষ ভেজাল দাবি করতে না পারেন এজন্য বিভিন্ন ল্যাবকে ম্যানেজ করে তারা ‘আসল’ সনদ নেয়ার চেষ্টা করেন। ফলে একদিকে অর্থ খুইয়ে, অন্যদিকে হাজতে গিয়ে সব হারাচ্ছেন ক্রেতা।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা যাদের গ্রেফতার করছি তারা মূলত ক্যারিয়ার (বাহক)।’

যা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, যা উদ্ধার হচ্ছে তার বেশিরভাগই সম্ভবত বিষ নয়।

আমরা টেস্ট করিয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব। তবে এ প্রতারক চক্রকে ধরার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। র‌্যাবের লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, সাপের বিষ নিয়ে অনেক রহস্য রয়েছে।

সে কারণে যেগুলো উদ্ধার হচ্ছে সেগুলোকে আমরা নিশ্চিতভাবে সাপের বিষ বলছি না। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের শুরুতে আমরা প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার করেছি। এরপর যখন ল্যাব থেকে পরীক্ষা হয়ে আসবে তখন তাদের বিরুদ্ধে চোরাচালান আইনে মামলা করব।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/388922/