৩০ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১১:১৬

মোটর বাইক দুর্ঘটনায় সড়কে ঝরছে প্রাণ

এক বছরে বাইক দুর্ঘটনায় নিহত ১ হাজার ৪৬৩ জন
নাছির উদ্দিন শোয়েব: ‘একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না’ এমন স্লোগান সংবলিত পোস্টার কতিপয় যানবাহনের গায়ে সাটানো থাকলেও সড়ক পরিবহন আইন মানছে না চালকরা। বাস-ট্রাকের চালকরা এখনো বেপরোয়া। যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ। বেড়ে গেছে মোটরবাইক দুর্ঘটনা। ফলে বাইক চালক এবং আরোহীরা বাস-ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। সম্প্রতি কয়েকটি মোটরবাইক দুর্ঘটনায় প্রানহারিয়েছেন সাংবাদিক, অভিনেত্রী ও দম্পতিসহ বেশ কয়েকজন। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঘটনার পর চালক ও সহকারীরা পালিয়ে গেলেও একপর্যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ে। তবে দুর্ঘটনার শিকার পরিবারটি আর ফিরে পায় না আর প্রিয় জনকে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষনে বলা হয়েছে, ‘ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন-বেপরোয়া গতি-চালকদের অদক্ষতাসহ ১০ কারণে ঘটেছে এসব দুর্ঘটনা’। ওই সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে দেশে এক হাজার ৩৭৮টি মোটরবাইক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৪৬৩ জন নিহত হয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫৪৩১ জন।

সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি বিকালে অফিস শেষে মোটরসাইকেলে খিলক্ষেত নিকুঞ্জের বাসায় যাওয়ার পথে প্রগতি সরণির যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে উত্তরাগামী ভিক্টর ক্লাসিকের একটি বাস পেছন থেকে ধাক্কা দেয় বেসরকারি ৭১ টেলিভিশনের ভিডিও এডিটর মোটরবাইক চালক গোপাল সূত্রধরকে। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বারিধারা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করার পথে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় নিহতের ভাই দুলাল সূত্রধর সড়ক পরিবহন আইনে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। এ ঘটনায় হেলপার মোহাম্মদ মাসুমকে ঝালকাঠি থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নিহত গোপাল সূত্রধরের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের পাটর্গ্বামে। তার স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। তিনি ২০১১ থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি এবং ২০১৪ থেকে ৭১ টেলিভিশনে ভিডিও এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হয় অভিনেত্রী আশা চৌধুরী। এ ঘটনায় বাইকচালক শামীম আহমেদকে (৩৫) আটক করে দারুসসালাম থানা পুলিশ। পুলিশ বলছে, আশা যে মোটরসাইকেলে ছিলেন সেটি চালাচ্ছিলেন তার দূরসম্পর্কের এই ভাই। তাকে আটক করা হয়েছে। ঘটনার দিনই সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা দায়ের হয়। পরবর্তীকে ট্রাক চালককেও আটক করা হয়। এদিকে আশার দুর্ঘটনার সময় পেছনে থাকা একটি গাড়ির ভিডিওতে দেখা যায়, একটি পিকআপের পেছনে মোটরসাইকেলে মোড় ঘুরতে দাঁড়িয়ে ছিল তার বাইকটি। হঠাৎ দ্রুতগতির একটি ট্রাক আশার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশার বাইকের রাইডার ডানদিকে আর আশা বামদিকে পড়ে যান।

গত ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী স্বামী-স্ত্রী নিহত হয়েছেন। এরা হলেন- আকাশ ইকবাল (৩৩) ও স্ত্রী মায়া হাজারিকা (২৫)। সকাল ৭টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বিমানবন্দর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মশিউল আলম জানান, সকালে স্বামী-স্ত্রী মোটরসাইকেলে করে যাওয়ার সময় বিমানবন্দর সড়কে পদ্মা ওয়েল গেটের পাশে আজমেরি পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। এরআগে গত বছর ১৮ নভেম্বর সিরাজগঞ্জে বাসচাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়; এছাড়া এ ঘটনায় আহত হয় আরও একজন। জেলার বেলকুচি উপজেলার সুবর্ণসাড়া এলাকায় সিরাজগঞ্জ-বেলকুচি সড়কে তারা হতাহত হন বলে বেলকুচি থানার ওসি গোলাম মোস্তফা জানান। নিহতরা হলেন- বেলকুচি পৌরসভার শেরনগর মহল্লার আব্দুল কুদ্দুস মুন্সীর ছেলে হযরত আলী (২৭) ও একই এলাকার আব্দুল হাকিমের ছেলে সবুজ (২৮)।

১৯ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে গোল্ডেন পরিবহনের একটি বাসের চাপায় তিন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মুকসুদপুর উপজেলার কলেজমোড় নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে। জানা যায়, রাতে একটি বাইকে করে তিনজন মুকসুদপুর কলেজ মোড় এলাকায় রাস্তা পার হচ্ছিল। এ সময় গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী গোল্ডেন পরিবহনের একটি বাস বাইকটিকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তিন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়। নিহতরা হলেন-মুকসুপুর উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামের বিল্লাল ঠাকুরের ছেলে ও মুকসুদপুর কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আল-আমিন ঠাকুর (২২), একই উপজেলার চন্ডিবর্দি গ্রামের আনোয়ার সরদারের ছেলে ফয়সাল সরদার (৩০) এবং একই গ্রামের সুফি শেখের ছেলে লিয়াকত শেখ (৩২)। দুর্ঘটনার সময় বাসের সঙ্গে মোটরসাইকেল জড়িয়ে যায়। পরে বাইক থেকে স্পার্ক হয়ে ফুয়েল ট্যাংকে আগুন ধরে বাসে আগুন লেগে যায়।

বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে দেশে চার হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৪৩১ জন নিহত এবং সাত হাজার ৩৭৯ জন আহত হয়েছেন বলে রোডটি সেফটি ফাউন্ডেশনের ‘সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২০’ এ বলা হয়েছে। রোডটি সেফটি ফাউন্ডেশন থেকে পাঠানো সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহত পাঁচ হাজার ৪৩১ জনের মধ্যে ৮৭১ জন নারী ও ৬৪৯ জন শিশু।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত বছর এক হাজার ৩৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক হাজার ৪৬৩ জন নিহত হয়েছেন। যা মোট নিহতের ২৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ২৯ দশমিক ১০ শতাংশ। দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫১২ জন পথচারী নিহত হয়েছে। যা মোট নিহতের ২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৮৩ জন। অর্থাৎ মোট নিহতের ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গত বছরব্যাপী ১১৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ২৭২ জন নিহত, ১৩৭ জন আহত ও ৬২ জন নিখোঁজ হন। ১০৮টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২২৮ জন নিহত ও ৫৪ জন আহত হন। মোট দুর্ঘটনার মধ্যে পাঁচ দশমিক ২৩ শতাংশ ঘটেছে ভোরে, ৩২ দশমিক ৮৮ শতাংশ সকালে, ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ দুপুরে ২০ দশমিক ০৪ শতাংশ বিকেলে, নয় দশমিক ৭৫ শতাংশ সন্ধ্যায় এবং ১৭ দশমিক ৭১ শতাংশ ঘটেছে রাতে। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। আর সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগেভ জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ময়মনসিংহে এবং সবচেয়ে কম মেহেরপুরে।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বি আরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছে এই সংগঠনটি। সেগুলো হলো-দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়াতে হবে; চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বি আরটিএ’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’র সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। পরিবহন খাতের এই নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থ রাজনীতির ধারাবাহিক চর্চার কারণে গড়ে উঠেছে। এখানে অনেকগুলো কারণ জড়িয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে। তবে প্রধান ও উৎস কারণÍ দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির তথাকথিত রাজনীতি। তাই সমস্যাটির সমাধান করতে হলে সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। দেশের সুষম ও টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সাশ্রয়ী ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা। সেজন্য জাতীয় স্বার্থেই সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সরকারের মনোযোগী হওয়া উচিত।

https://dailysangram.com/post/442210