৩০ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১১:১৩

“করোনাভাইরাস হচ্ছে শয়তান”

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গতবছর বলেছিলেন, “করোনাভাইরাস হচ্ছে শয়তান।” তাঁরা শয়তান প্রতিরোধের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
চিনকে আগে খুব দূরের মনে করা হলেও এখন কিন্তু কাছের। দেশটি আয়তন ও জনসংখ্যাতেও যথেষ্ট বড় বাংলাদেশের চেয়ে। অনেক বাংলাদেশী সেখানে বসবাস করেন। ব্যবসা চালান। কেউ কেউ পড়াশোনা করেন। বহু চিনা নাগরিকও আমাদের দেশে আছেন। কাজ করেন। ব্যবসা পরিচালনা করেন। দেশটি আমাদের বন্ধুও বটে। চিনেই করোনার আক্রমণ শুরু হয় প্রথম। এরপর তাইওয়ান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নেপাল, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও আমেরিকাসহ দুই শতাধিক দেশে করোনাভাইরাসের তুমুল তাণ্ডব চলছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আমেরিকা- ইউরোপসহ বহুদেশ। ইতোমধ্যে বিশ্বে এ রোগে মারা গেছে ২২ লাখের মতো মানুষ। আক্রান্ত প্রায় ১০ কোটি। এ ভাইরাসে ৯ হাজারের বেশি মানুষ মরেছে আমাদের দেশেও। এর মধ্যে ভ্যাকসিন আসলেও কতটা সুরক্ষা হবে এ দিয়ে তা বলা মুশকিল।
জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা করোনাভাইরাসের প্রধান উপসর্গ হলেও এর ধরন বদলেছে। এখন ডায়রিয়াসহ আরও নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, সার্সের পর এটি ভয়াবহ রোগ।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা গতবছর ১০ জানুয়ারি চিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য নতুন এ রোগের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে কী কী ব্যবস্থাগ্রহণ করা প্রয়োজন সে সম্পর্কে অন্তর্র্বর্তীকালীন গাইডলাইন প্রণয়ন করেছিল। গাইডলাইনে কীভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে, নমুনা পরীক্ষা, রোগীর চিকিৎসা, স্বাস্থ্য কেন্দ্রসমূহে সংক্রমণ প্রতিরোধ, চিকিৎসাসামগ্রীর পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিতকরণ ও ভাইরাসটি সম্পর্কে জনসচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করে। আক্রান্তদের সামলাতে চিনে নতুন নির্মাণসহ বহু হাসপাতালও রেডি রাখা হয়েছিল। তবে প্রায় ৬ মাস যাবৎ চিনে করোনায় কেউ মারা যায়নি। বাংলাদেশেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। কিন্তু মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। প্রকোপ কমেছে তা বলা যায়।

আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চিন থেকে সরাসরি ফ্লাইটে আসা যাত্রীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিল। কিন্তু করোনা ঠেকাতে পারেনি।
বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণে চিনের সঙ্গে বাংলাদেশের নিয়মিত ফ্লাইটে যাত্রী যাতায়াত করেন। তাই নতুন ধরনের ভাইরাসজনিত রোগটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বার আশঙ্কা থাকায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। হয়তো এতে কিছু কাজ হয়েছে বলেই আমাদের মৃত্যুহার কম। আক্রান্তের সংখ্যাও কম।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান চিনের উহান শহরে দেখা দেয়া রোগ ‘করোনাভাইরাস’ এর সংক্রমণরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। চিন ও হংকংসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফ্লাইটে ঢাকা এয়ারপোর্টে নিয়মিত যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। তাই এ রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি ছিল। চিন ও হংকংসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফ্লাইটে আসা যাত্রীদের বিশেষ ধরনের স্বাস্থ্যকার্ড সরবরাহ করবার মাধ্যমে স্ক্রিনিং করা, শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যাসহ নতুন এ রোগের উপসর্গ রয়েছে কি না, তা যাত্রীদের কাছ থেকে জানবার উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের চিকিৎসকদের নতুন এ রোগটি সম্পর্কে অবহিত করা হয়। পাশাপাশি জনগণের মাঝেও এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। রোগনিয়ন্ত্রণে সিডিসি শাখার উদ্যোগে গণমাধ্যমকে অবহিত করতে গতবছর ২০ জানুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি ওরিয়েন্টেশনের আয়োজন করা হয়।

উল্লেখ্য, ‘করোনাভাইরাস’ এক প্রকার নিউমোনিয়া। এর সংক্রমণের ধরনপ্রকৃতি এবং চিকিৎসাপদ্ধতি জটিল। এজন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং রোগনিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন শুরুতেই। তবে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও সতর্ক থাকলে ততোটা শঙ্কিত হবার কোনও কারণ নেই।

চিন থেকে বলা হয়, বন্যপ্রাণি থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে দেশে। কেউ বলছেন, সাপ থেকে এটা ছড়িয়েছে। চিনারা সাপসহ প্রায় সবরকম বন্যপ্রাণির মাংস খায়। তাই প্রায় ১ বছর ধরে সেখানে বন্যপ্রাণি ধরা এবং বেচাকেনা নিষিদ্ধ। কুকুর, বেড়াল, ইঁদুর, ছুঁচো, ভোদর, কাঠবেড়ালি, বাঘ, ভাল্লুক, বাঁদর, হনুমান, পাণ্ডা, শেয়াল, বাদুড় সবই ওদের প্রিয়খাদ্য। এসব প্রাণির মাংস খেলে মারাত্মক রোগজীবাণুর সংক্রমণ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এ জন্য মুসলিমদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট প্রাণির গোশত ব্যতীত ঢালাওভাবে সবপ্রাণির গোশত খাওয়া হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ কুকুর, বেড়াল, শেয়াল, বাদুড়, বাঁদর, শূকরসহ আরও অনেক প্রাণির দেহে রিটা, করোনার মতো মারাত্মক ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। কিন্তু অমুসলিমরা এসব বাছ-বিচার করেন না। ফলে পশু-পাখির দেহে থাকা মারাত্মক ক্ষতিকর ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে সংক্রমিত হবার আশঙ্কা থাকে। তাই বিবেকবান মানুষ বিশেষত মুসলিমরা সব প্রাণির মাংস ভক্ষণ করেন না।

উল্লেখ্য, চিন, কোরিয়াসহ অনেক দেশের মানুষ বন্যপশুর মাংস ভক্ষণ করেন। এতে মানুষের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটা খুবই স্বাভাবিক। মুসলিমরা অবশ্য সববন্যপ্রাণির গোশত খান না। কিন্তু যারা খান তাঁদের দেহ থেকে মুসলিমদের দেহেও এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে সহজেই। কাজেই মুসলিমদের সাবধান থাকতে হবে আরও। ঢালাওভাবে সবার সঙ্গে মেলামেশা থেকে এসময় বিরত থাকা উচিত। এ রোগটি সার্সভাইরাসের গোত্রভুক্ত বলে জানানো হয়। ফুসফুস, লিভার ও কিডনি আক্রান্ত হয় এবং ধীরে ধীরে সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে।

উহানে আটকাপড়া বাংলাদেশিদের যারা দেশে ফিরতে আগ্রহী ছিলেন তাঁদের ফিরিয়ে আনতে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এজন্য তাঁদের অন্তত ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সবরকম প্রস্তুতির নির্দেশনা প্রদান করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হু। বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোসহ নৌ ও স্থলবন্দরগুলোতেও স্ক্যানার বসানো হয়েছিল। বাংলাদেশিদের চিনভ্রমণ নিষিদ্ধ না করলেও সতর্কতা জারি করা হয়।

অভিযোগ উঠেছে, চিনে করোনাভাইরাসে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা কম করে বলা হয়। আসলে পরিস্থিতি ছিল ধারণার চাইতে অনেক বেশি মারাত্মক।

মহা আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, কোনও একটি সূত্র সেসময় জানায়, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সারাবিশ্বে সাড়ে ৬ কোটি মানুষের ভবলীলা সাঙ্গ হবে। ইটস নট এ জোক! এমন ভয়াবহ তথ্য ছড়ানো থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত থাকা উচিত।

উল্লেখ্য, নির্মাণাধীন পদ্মাব্রিজে প্রায় এক হাজার চিনা ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছেন। তাঁরা অনেকে সেসময় নিজদেশ ঘুরে এসেছেন। তাঁদের কারুর মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে কিনা খতিয়ে দেখা জরুরি ছিল। এজন্য তাঁদের কাজে যোগদান থেকে বিরতও রাখা হয়েছিল কিছুদিন।

করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের দ্রুত ভর্তির জন্য চিনে প্রতি ৬ দিনে একটি করে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল তৈরি করা হয়। আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ চিনে এমন অসম্ভবও সম্ভব।
উল্লেখ্য, এশিয়ার চেয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা এখনও তাণ্ডব অব্যাহত রেখেছে। লকডাউন, কার্ফিউ চলছে অনেক দেশে। তবে বাংলাদেশ অনেক ভালো আছে এখনও। মৃত্যুহারও কমছে। তবে এখনও সচেতন থাকতে হবে আমাদের। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে হয়তো আরও অনেক দিন। যারা মাস্ক না পরে যানবাহনে চলাচল করেন, হাটবাজারে ঘোরেন তাঁরা আত্মঘাতী। এদের রুখতে না পারলে ভোগান্তি বাড়বে। হয়তো মৃত্যুও ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।

আরেকটা কথা: আমাদের দেশে ভ্যাকসিন এসে গেছে। গত ২৭ জানুয়ারি থেকে এর প্রয়োগও শুরু হয়েছে। অনলাইনে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টিকা দেয়া হয় ২৫ জনকে। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে সারাদেশে ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম। টিকা নিতে আগ্রহীদের অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তবে শেষ হতে সময় লাগবে। ভ্যাকসিন নেবার পরও কিন্তু মাস্কপরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

বৃটেনে করোনার যে নতুন ধরন পাওয়া গেছে তা খুবই ভয়াবহ বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।

চিনা প্রেসিডেন্টের ভাষায় ‘শয়তান’ এখনও বিশ্বজুড়ে অপ্রতিহত দাপট চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকা বলা যায় বিপর্যস্ত। কাজেই এ ঘাতক শয়তান করোনা উপেক্ষা করবার সুযোগ নেই।

https://dailysangram.com/post/442203