২৯ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:০৮

স্বাস্থ্য খাতের লুটপাটের প্রভাব দুর্নীতির সূচকে

২০২০ সালের বৈশ্বিক দুর্নীতি সূচকে দুই ধাপ অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের। এবার ১৮০টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের ক্রম তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। সর্বনিম্ন স্কোর বা দুর্নীতির ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি বিবেচনায় বাংলাদেশের এই অবনমন হয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের এই অবস্থান ছিল ১৪তম; ২০১৮ সালে ছিল ১৩তম।

তবে সর্বোচ্চ স্কোর বা কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের ক্রম তালিকায় আগের বছরের মতোই এবারও ১৪৬তম স্থানে বাংলাদেশ; এর আগে ২০১৮ সালে ছিল ১৪৯ নম্বরে। এবার সূচকে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনমনের পেছনে করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক দুর্নীতিকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীনতা, মতপ্রকাশ ও জবাবদিহির অভাবকে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) সারা বিশ্বে একযোগে ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২০’ প্রকাশ করেছে। এর অংশ হিসেবে দেশে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পক্ষ থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

দুর্নীতি সূচকে এবার ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬। আগের দুই বছর ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৬। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ সর্বনিম্ন অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে একমাত্র আফগানিস্তানই বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। তবে এবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদান। আর সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ বিবেচিত হয়েছে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের এই অবস্থানকে হতাশাব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি হয়নি, বরং নিচের দিক থেকে হিসাব করলে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনতি হয়েছে। এই ফলাফলকে আমরা হতাশাব্যঞ্জক বলে মনে করছি।’

তিনি বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আমরা সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিলাম, তারপর সর্বোচ্চ স্কোর বা ওপর থেকে ক্রমাগত র্যাংকিং বেড়েছে। কিন্তু এবার দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন দিক থেকে বাংলাদেশ চতুর্থ। এর জন্য করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক দুর্নীতিসহ বেশ কয়েকটি কারণ দায়ী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।’

জরিপে ০ থেকে ১০০ নম্বরের স্কেলে ১৮০টি দেশকে নম্বর দেওয়া হয়। সবচেয়ে কম নম্বর যে দেশ পায় সেই দেশের স্কোর সবচেয়ে কম হয় এবং সে অনুযায়ী সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তার অবস্থান থাকে শীর্ষে। এবার দুর্নীতি ধারণা সূচকে বৈশ্বিকভাবে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত তথ্য নেওয়া হয়েছে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের অবনমন হওয়ার পেছনে ক্ষমতার অপব্যবহার, গণতন্ত্রের জবাবদিহির কার্যকারিতার অবদমন, বিচারহীনতার সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন উপাদান প্রভাব ফেলেছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর করোনা মোকাবেলায় নানা দুর্নীতি, উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্ত রুই-কাতলদের বিচারের আওতায় আনার ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় খাতে কেনাকাটায় রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম, গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার বিষয়গুলোও দায়ী। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুর্নীতি তো আছেই।

টিআই জানায়, এবারের সূচকে গড় স্কোর হলো ৪৩। এ বছর ৫৩টি দেশ ৪৩ স্কোর বা তার বেশি পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি স্কোর করেছে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড, তারা ১০০-এর মধ্যে ৮৮ স্কোর পেয়েছে। সবচেয়ে নিম্ন স্কোর ১২ পেয়েছে সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদান। এ ছাড়া এবার ৬২ দেশের স্কোর বেড়েছে। ৭০টি দেশের স্কোর আগের মতোই রয়েছে এবং ৪৮টি দেশের স্কোর নেমে এসেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

টিআইয়ের ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান। দেশটি ৬৮ স্কোর পেয়ে উচ্চক্রম অনুযায়ী ২৪তম, এরপর ভারত ৪০ স্কোর পেয়ে ৮৬তম, শ্রীলঙ্কা ৩৮ পেয়ে ৯৪তম, নেপাল ৩৩ পেয়ে ১১৭তম, পাকিস্তান ৩১ পেয়ে ১২৪তম, মালদ্বীপ ৪৩ পেয়ে ৭৫তম এবং আফগানিস্তান ১৯ পেয়ে ১৬৫তম। আর বৈশ্বিক তালিকায় সর্বনিম্ন ১২(১৩) স্কোর পেয়ে সোমালিয়ার পরেই আছে দক্ষিণ সুদান। এ ছাড়া সর্বনিম্ন ১৪(১৩) স্কোর নিয়ে সিরিয়ার অবস্থান ১৭৮তম। আর ১৫(১৫) স্কোর নিয়ে ইয়েমেনের অবস্থান ১৭৬তম। অন্যদিকে সর্বোচ্চ ৮৮ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থানে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড। এ ছাড়া ৮৫ স্কোর নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ফিনল্যান্ড।

ইফতেখারুজ্জামান জানান, ২০২০ সালের প্রতিবেদনের তথ্যের উৎস ১৩টি আন্তর্জাতিক জরিপ। বাংলাদেশের জন্য আটটি সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে টিআইবির কোনো গবেষণা বা প্রতিবেদনের কোনো তথ্য এতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

অবস্থানের উন্নতি ঘটাতে সুপারিশ

দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি ঘটাতে বেশ কয়েকটি সুপারিশও করেছে টিআইবি। এর মধ্যে আছে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন, সামাজিক অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে সব দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনা, রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে নিজেদের সম্পদ বিকাশের লাইসেন্স হিসেবে বিবেচনা করার সংস্কৃতিতে পরিবর্তন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে এবং বেসরকারি খাতে বেনামি মালিকানা, সেটা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনি কাঠামো জোরদার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বাড়ানো, জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন—বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও জাতীয় সংসদের কার্যকারিতা বাড়ানো এবং এসব প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, যত ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন হয় সেটা শেয়ারিংয়ের যে পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী চালু আছে, সেটাতে অংশ নেওয়া, ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে তথ্য অধিকার আরো দ্রুত ও বিস্তৃত করা এবং সাধারণ মানুষ, এনজিও, গণমাধ্যম যেন জবাবদিহি চাইতে পারে সেই সুযোগ বাড়ানো।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৯৫ সাল থেকে টিআই এ সূচক প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ ২০০১ সাল থেকে এ জরিপে অংশ নিচ্ছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/01/29/999754