২৯ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:০৭

ভোগান্তি কমছে না

রাজধানীতে যানজট নিরসনে তিনটি ইউটার্ন চালু : এ পদ্ধতি অবৈজ্ঞানিক, কোনোদিনও কাজ করবে না : ড. শামসুল হক

রাজধানীর যানজট নিরসনে সাতরাস্তা থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ১০টি ইউটার্ন নির্মাণ করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তারই অংশ হিসেবে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর তেজগাঁও বিজি প্রেসের সামনে, নাবিস্কো মোড় এবং বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় তিনটি ইউটার্ন চালু করেছে ডিএনসিসি। তবে ইউটার্ন চালু হওয়ার একমাস পেরিয়ে গেলেও এই রোডের যানজট কমার পরিবর্তে আরো বেড়েছে। ইউটার্নের ডিজাইন জটিলতায় প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশা এবং বাইকের মতো ছোট গাড়িগুলো খুব সহজেই পার হতে পারলেও বাস বা ট্রাকের মতো বড় গাড়িগুলো ইউটার্ন দিয়ে ঘুরতে পারছে না। ইউটার্ন করার পরও আগের ক্রসিংগুলো বন্ধ করা হয়নি। একদিকে ইউটার্নের কারণে রাস্তা সরু হওয়া, আরেকদিকে আগের চলমান ক্রসিং সিগনালের কারণে ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। যাতায়াতের সময়ও বেড়েছে আগের চেয়ে।

সড়কের গাড়িচালক, পথচারীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউটার্নের ফলে সড়ক আগের চেয়ে সরু হয়েছে। গাড়িও চলছে ধীরগতিতে। আবার ক্রসিংগুলোও খোলা রয়েছে। আগের মতোই সিগন্যালের জ্যামে পড়তে হচ্ছে। তবে কেউ কেউ বলছেন, যানজটের দুর্ভোগ না কমলেও ইউটার্ন চালুর ফলে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলছে।

গতকাল বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় খুলে দেওয়া ইউটার্ন সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফার্মগেট থেকে মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে এই ইউটার্ন পার হতে ছোট-বড় যানবাহনগুলোর যানজটে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ। এছাড়াও তেজগাঁও থেকে বিমানবন্দরমুখী গাড়িগুলোও মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে সিগন্যালের জন্য। একইভাবে উত্তরা-আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর হয়ে আসা গাড়িগুলোর অবস্থাও একই।

সাধারণ পথচারী ও যাত্রীরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি যানজটে পড়তে হয় সকালে অফিস যাওয়ার সময় এবং বিকেলে। এখনতো বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ তাতেই এই অবস্থা, সব স্কুল খুলে দিলে দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

টঙ্গী থেকে গুলিস্তানের দিকে চলাচলকারী স্কাই লাইন পরিবহনের এক গাড়ি চালক বিরক্তি নিয়ে বলেন, ইউটার্নের ফলে সড়ক আগের চেয়ে সরু হয়ে এসেছে। এতে গাড়িও চলছে ধীরগতিতে। আবার ক্রসিংগুলোও খোলা রয়েছে। আগের মতোই সিগন্যালের জ্যামে পড়তে হচ্ছে। আমাদের ট্রিপের সংখ্যা কমে গেছে। তাছাড়া গাড়িগুলো বেশিক্ষণ যানজটে আটকে থাকার ফলে যাত্রীরা বাস থেকে নেমে যাচ্ছে। এতে লসে পড়তে হচ্ছে তাদের।

এদিকে বনানী সিগনালে আটকে থাকা বাসের ড্রাইভার রফিক মিয়া জানান, ইউটার্নে লাভ-ক্ষতি দুইটাই তাদের নিতে হচ্ছে। ছোট ছোট গাড়িগুলো ইউটার্নে ঢুকে গেলে যে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে তাতে থেমে থাকা বাসে খুব সহজেই যাত্রী নামাতে কিংবা তুলতে পারছে। প্রাইভেট কারের মতো ছোট গাড়ি গুলো ঢুকতে পারলেও বাস ঢোকার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের ক্ষতির দিকটাই সর্বোচ্চ।

বনানী চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় ইউটার্ন নিতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না ট্রাফিক সিগন্যালের। ছোটবড় বাসও অনায়াসেই বাঁক নিচ্ছে। তবে উভয় পাশের গাড়ির চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের। এই রুটের যাত্রীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, এই ইউটার্ন স্বস্তির বদলে অস্বস্তিই উপহার দিয়েছে। এছাড়া একটু পরপরই গাড়িগুলো সিগন্যালে পড়ায় যাতায়াতের সময়ও লাগছে বেশি। এই একটি এলাকার যানজটের প্রভাব গিয়ে পড়ছে ফার্মগেইট, তেজগাঁও, মগবাজার, মালিবাগ, কাকলাইল হয়ে পল্টন পর্যন্ত। অন্যদিকে রোকেয়া স্মরণী, জাতীয় সংসদ হয়ে ধানমন্ডি, নিউমার্কেট এবং শ্যামলী, কল্যাণপুর হয়ে গাবতলী পর্যন্ত।

যদিও ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ইউটার্ন উদ্বোধনকালে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, এই ইউটার্নগুলো চালু করার ফলে এই সড়কে যানজট আরও কমে যাবে। বাঁচবে যাতায়াতের সময়ও। ইউটার্নগুলো চালু হলে নগরীর ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমে যাবে।

তবে মেয়রের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই ইউটার্ন আছে। তবে কোথাও এতো সরু রাস্তায় ইউটার্ন নেই। এই ইউটার্ন পৃথিবীর যেসব স্থানে কাজ করে সেখানে গাড়ি প্রতি ঘণ্টায় ১১০ কি.মি. বা তার বেশি গতিতে চলে। সহজ কথায় বলা যায়, আধুনিক যুগে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে কবিরাজের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়া। এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যে রোডগুলো সরু, ওই রোডগুলোতে কিন্তু ইউটার্ন বা ইউলুপের দাওয়াইটা প্রযোজ্য ছিল না। এই ইউলুপের দাওয়াইটা দিতে হয় যেখানে রাস্তা অনেক চওড়া, সোজা গাড়ির সংখ্যা বেশি, মোড়ের সংখ্যা কম।

তবে ডিএনসিসির ইউটার্ন প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী খন্দকার মাহবুব আলম এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, সাত রাস্তা থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত সড়কের সবকয়টি ইউটার্ন চালু হলে নগরবাসী এর কার্যকর সুফল পাবেন। আংশিক চালু হওয়ায় কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটুকু বলতে পারি, এসব ইউটার্নের সুফল রাজধানীবাসী ভোগ করবেন।

কিন্তু অধ্যাপক ড. শামসুল হক মনে করেন, ঢাকা শহরের মতো রাস্তায় ইউটার্ন কোনদিনই কাজ করবে না। যারা এই কাজ করেছে, তারা না জেনেই করেছে। ইউটার্ন বা ইউলুপ সঠিকভাবে কাজ করার কিছু পদ্ধতি আছে। প্রথমত, যেখানে গাড়ির চাপ কম। দ্বিতীয়ত, যেখানে রাস্তা যথেষ্ঠ প্রশস্ত। এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। যারা এই কাজ করেছে তারা বিজ্ঞানকে অবজ্ঞা করেছে।

রাজধানীর উত্তরা হাউজ বিল্ডিং থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা পর্যন্ত ১০টি ইউটার্ন নির্মাণ করছে ডিএনসিসি। প্রকল্পের শুরুতে মোট ১১টি ইউটার্ন নির্মাণ করার পরিকল্পনা থাকলেও আর্মি গলফ ক্লাব সংলগ্ন ইউটার্নটি বাতিল করা হয়। মূল প্রকল্পটির অনুমোদিত ব্যয় ২৪ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা থাকলেও প্রথম সংশোধনের পর এ প্রকল্পের ব্যয় ৩১ কোটি ৮০ লক্ষ ৯৭ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/353877