২৯ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:০২

করোনা ভ্যাকসিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় মানুষ

গত ১০০ বছরে রোগ প্রতিষেধক টিকার কারণে কোটি কোটি মানুষের জীবনরক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু অনেক দেশেই টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে অনীহা তৈরি হয়েছে, আর এই প্রবণতা এখন বাড়ছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকা নেয়া না নেয়ার প্রশ্নে অনেক মানুষের মাঝেই এক ধরনের সংশয় বা আস্থার অভাব দেখা যাচ্ছে। বিরোধী দল বিএনপি অভিযোগ তুলেছে, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা ভিআইপিরা আগে টিকা না নেয়ায় সংশয় বাড়ছে। তবে সরকার মনে করছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংশয় তৈরি করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ দলটির অনেক নেতাই বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের সমালোচনা করছেন। করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে গুজব-অপপ্রচারে অনেকের মধ্যে যে ভীতি-সংশয় তৈরি হয়েছে, তা দূরতেই প্রথম ধাপেই টিকা নিয়েছেন সরকারের দুজন প্রতিমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে দেশের ৫২ শতাংশ মানুষ আছেন, তারা ঠিক এ মুহূর্তেই টিকা নিতে রাজী নন। বরং তারা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তবেই টিকা নিতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন গবেষণা দলটির অন্যতম সদস্য ড. শাফিউন নাহিন শিমুল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৩,৫০০ লোকের ওপর জরিপ চালিয়ে এই ফলাফল পাওয়া গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় যা পাওয়া গেছে, দেশের আট বিভাগের আটটি জেলা ও ষোলটি উপজেলায়, এবং ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনে জনসমাগম বেশি এমন জায়গাগুলোতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপে পাওয়া গেছে যে ১৬শতাংশ মানুষ কখনোই টিকা নিতে চাননা। মোট ৮৪% মানুষ টিকা নিতে আগ্রহী তবে এর মধ্যে ৫২% এখনই না নিয়ে ধীরে সুস্থে নিতে আগ্রহী।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকা নেয়া না নেয়ার প্রশ্নে অনেক মানুষের মাঝেই এক ধরনের সংশয় বা আস্থার অভাব দেখা যাচ্ছে। বিএনপি অভিযোগ তুলেছে, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা ভিআইপিরা আগে টিকা না নেয়ায় সংশয় বাড়ছে। তবে সরকার মনে করছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংশয় তৈরি করা হচ্ছে। বিএনপি চাইলে তাদের আগে টিকা দেওয়ার জন্য সুপারিশ করবেন বলে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বক্তব্য দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেন, ভেজাল’ টিকা দিয়ে দেখবে বিএনপি মরে কি না, এরপরে তারা নেবে। এছাড়া ফেইসবুকসহ সোশাল মিডিয়ায় এই টিকা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা তৈরি হয়। মন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা কেন প্রকাশ্যে টিকা নিচ্ছেন না, সেই প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ।

এদিকে করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে সংশয়ের কারণে এখনই তা নিতে চান না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী নাহিয়ান। তিনি বলেছেন, এমন চিন্তার পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও টিকা নিয়ে তার মনে একটা আস্থার অভাব তৈরি হয়েছে।

আমরা দেখছি বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন নেয়ার ফলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে। যদিও এটা ভ্যাকসিন নেয়ার জন্যই কিনা- সেটা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। তারপরও গণমাধ্যমে অথবা ফেসবুকে বিভিন্ন খবরে এগুলো আসছে। সেটার কারণে মনে একটা ভয়, আতংক বা সংশয় থেকেই যাচ্ছে যে, টিকা নেয়ার সুযোগ হলে আমি নেবো কি নেবো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর মতো বিভিন্ন পেশার বা সাধারণ মানুষের অনেকেই এখন নানাভাবে তাদের আস্থার অভাব বা সংশয় প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে চলছে ব্যাপক আলোচনা।

বিশ্বজুড়েই ভ্যাকসিনের ব্যাপারে নানা কথাবার্তা রয়েছে। গণমাধ্যমে নানা রকম নিউজ হচ্ছে। সেজন্য আমেরিকা এবং ইউরোপেও মানুষের মাঝে একটা ভীতি আছে, একটা সন্দেহ আছে। বাংলাদেশেও টিকা নিয়ে ভয় এবং সন্দেহ বেশ ভালভাবেই আছে" বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে ঢাকার মাঠ পর্যায়ে কাজ করা সাংবাদিক রিপোর্টারদের বিনামূল্যে টিকা দেয়ার ঘোষণা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক। সেমতে করোনার ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য নিবন্ধন আহ্বান করে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ডিআরইউ। গতকাল বৃহস্পতিবার ডিআরইউ’র কল্যাণ সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাাহ জানান, প্রথম ধাপে ২১৮ জন নিবন্ধিত হয়েছেন। ডিআরইউর সদস্য সংখ্যা ১৮০০ হলেও নিবন্ধনের সংখ্যা কম। তিনি বলেন যা নিবন্ধন করা হয়েছে তা স্বেচ্ছায়। কারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে এর দায় কে নেবে।

একটি বেসরকারি টেলিভিশনে মঙ্গলবার দেখা হয় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, আগে মানুষ টিকা নিয়ে নিক। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখি। তারপর সিদ্ধান্ত নেবো।

করোনাভাইরাস নিয়ে সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান অধ্যাপক মোঃ: শহীদুল্লাহ বলেছেন, ভারতের উপহার এবং কেনা টিকা নিয়ে সংশয়ের কোন ভিত্তি নেই। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা শুধু ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউটে উৎপাদন করা হয়েছে। ভারতের উপহার এবং কেনা টিকা-দু'টো টিকাই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার। এগুলো ভারতের আবিষ্কার নয়। ফাইজার এবং মডার্নাসহ যে টিকাগুলো এখন বিশ্বে রয়েছে, তার মধ্যে অক্সফোর্ডের এই টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম হয়েছে। এদিকে, কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই টিকা নিয়ে সংশয় যাতে না থাকে, সেজন্য বিশেষজ্ঞ মতামত প্রচার করা এবং এর বিজ্ঞান সম্মত বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর কর্মসূচিও সরকার নিয়েছে।

এদিকে টিকা প্রাপ্তি নিয়েও সংশয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। যদিও কেউ কেউ করোনাভাইরাসের টিকা নিতে আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন। আবার কেউ টিকা নেবেন না বলে সোজা জানিয়ে দেন। ফার্মগেটে পান সিগারেট বিক্রেতা সিয়াম বলেন, দেশেতো টিকা আসতেছে শুনলাম টিভিতে। এই টিকা আগে বড়লোকরা পাক। এরপর তারা কয়েকবার করে নেয়ার পর যদি আমরা পাই নেবো। আর তারা নিতে নিতে টিকা নকলও হয়ে যেতে পারে।

মালিবাগ রেলগেট সংলগ্ন চা দোকানি মো. লিটন। তিনি বলেন, দেশে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন আসবে তা জরুরি সেবায় নিয়োজিতরাই পাবেন। আমরা পাবো কীভাবে? আমরা তো সাধারণ মানুষ। ভ্যাকসিন কল্পনায়ও আনতে পারছি না। মারা গেলে এমনিতেই যাবো। ভ্যাকসিন আমাদের দরকার হবে না।

কাওরান বাজার এলাকায় ব্যবসা করেন আবদুল লতিফ। করোনার ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না তিনিও। বলেন, আমরা দিন আনি দিন খাই। লকডাউনের সময়ে কোনো কাজকর্ম করতে পারিনি। ভ্যাকসিন তো অনেক দামি জিনিস। এটা কি আর আমরা পামু। একই কথা বললেন, বাদাম বিক্রেতা মাসুম। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন না পেলেও কষ্ট নেই। কারণ গরিব মানুষদের ভ্যাকসিন লাগে না। আমার ভ্যাকসিন পাওয়ার আগে খাওয়া-থাকার নিশ্চয়তা চাই।

রিকশাচালক কবির হোসেন বলেন, ভ্যাকসিন নিবো না। ওসব আমাদের লাগবে না। আমরা খেটে খাই। ভাতই পাই না, ভ্যাকসিন দিয়ে কি করমু। যাদের প্রয়োজন তারা ভ্যাকসিন নিবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, ভ্যাকসিন সম্পূর্ণ ফ্রিতে দিলে নিতে পারি। কিনে নেয়ার জন্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সামর্থ থাকবে না। সরকার যদি প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের দিয়ে সঠিকভাবে বণ্টন করে তাহলে আমজনতা ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নয়তো কোনোভাবেই গরিব মানুষের কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছাবে না।

https://dailysangram.com/post/442078