২৯ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১১:০১

ব্যাংক নয় মুদি দোকানের ক্যাশ বাক্স?

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : এই নিবন্ধের নাম দেয়া যেত ‘মগের মুল্লুক’। কিন্তু মগের মল্লুকের দু’ধরনের অর্থ আছে। তার একটি হচ্ছে মগ-জলদস্যুদের পৈশাচিক বীভৎস নির্যাতন আর একটি হলো যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। ‘মগের মুল্লুক’ কথাটা এই দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। আমি বলতে চাইছি, বাংলাদেশে এখন যার যা খুশি তাই করার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে কোনো কৈফিয়ত নেই, কোনো জবাবদিহিতা নেই, আইন-কানুনের বালাই নেই। ভয়-ডর নেই। সবকিছু স্বাধীন, নিজ স্বাধীন হয়ে গেছে।

আমি দু’টি সামান্য সংবাদের উদ্ধৃতি দিতে চাই। একটি সংবাদ মধুমতি ব্যাংক নিয়ে। এই ব্যাংকের মালিক আওয়ামী লীগের হোমরা-চোমরারা। তাদের মধ্যে আছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিক ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় আওয়ামী নেতাদের লুণ্ঠনের জন্য বহু সংখ্যক ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে। মনে হয়, তার পেছনে কারণ আওয়ামী লুটেরাদের লুটের সুবিধা দেবার জন্য। সে কারবার সর্বত্র চলছে, প্রকাশ্যে কিংবা নীরবে নিভৃতে।

এসব আওয়ামী কর্তৃত্বাধীন ব্যাংক কীভাবে চলছে, তার একটা ছোট্ট প্রমাণ পাওয়া গেল মধুমতি ব্যাংকের চরফ্যাশন শাখার কর্মকান্ডে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, মধুমতি ব্যাংকের ভোলার চরফ্যাশন শাখার ৯ কোটি টাকার অনিয়ম নিয়ে তোলপাড় চলছে। আর সেই অনিয়মের তীর যার দিকে সেই ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে গোপন তথ্য তুলে ধরলেন। তিনি নিজের দায় না এড়িয়ে ভোলা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তিনি বাধ্য হয়েই ব্যাংকে ৯ কোটি টাকার অনিয়ম করেছেন।

ঐ শাখার সাবেক ম্যানেজার মো: রেজাউল করিম লিখিত বক্তব্যে বলেন, ২০১৫ সালের ২৩ নবেম্বর থেকে তিনি ভোলার চরফ্যাশনে মধুমতি ব্যাংক শাখার ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের ভাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভ ও তার ভাতিজা চরফ্যাশন শাখা অফিসার তরিকুল ইসলাম নিয়ন্ত্রণ করতেন সবকিছু। তারা ব্যাংকের ক্যাশ থেকে কোটি কোটি টাকা কোথায় নিত, কি করত, কিছুই জানাতো না। বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকা এই ব্যাংকের ভল্টে রাখা হতো। এ বিষয়ে তিনি জানতে চাইলে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হতো বলে জানান সাবেক ম্যানেজার মো: রেজাউল করিম। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে ১২টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৬ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। এই টাকা ভোলা ৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের ভাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভ তার বিকাশ ব্যবসার জন্য নিয়ে যায়। এরপর সে ঐ টাকা আটকে ফেলে। ম্যানেজার টাকা চাইলে মাত্র ৪৫ লাখ টাকার একটি চেক দেন জাহিদুল ইসলাম। সে চেকটিও ডিজঅনার হয়।

এভাবে প্রায় প্রতিদিনই সৌরভ ৫, ৬, ৭ এমনকি ১২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিয়েছিলেন। তরিকুল ইসলাম দুই কোটি ৮৫ লাখ তার ব্যবসার জন্য ব্যবহার করে সে টাকা আর ফেরত দেননি। তারা সব সময় এভাবে টাকা নিয়ে যেতেন, আর বিকেলে বা পরের দিন ফেরত দিয়ে যেতেন। এরপর গৃহীত টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করতে শুরু করেন।

এদিকে জাহিদুল ইসলাম সৌরভ ও তরিকুল ইসলাম শরীফ মধুমতি ব্যাংকের ভল্টের টাকা গ্রামীণ এন্টারপ্রাইজ, চার দেওয়াল ডেকোরেটর ও কায়িফ এন্টারপ্রাইজ, উপকূল ব্রিকস, মিলন ট্রেডার্স, মা ট্রেডার্স, উপকূল কনস্ট্রাকশন, রুহি ফার্নিচার্সসহ একাধিক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রায়ই তারা এসব অর্থ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতেন বলে রেজাউল অভিযোগ করেন। তারা মধুমতি ব্যাংকের চরফ্যাশন শাখাকে পারিবারিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। এই ব্যাংকের মালিকদের মধ্যে স্থানীয় এমপি জ্যাকবের নাম থাকায় তার পরিবারের সদস্যদের ইশারায় ব্যাংকের চরফ্যাশন শাখা পরিচালনা করতে হতো বলে জানান সাবেক ম্যানেজার।

দুর্নীতি দমন কমিশন ভোলা-৪ আসনের এমপি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মধুমতি ব্যাংক চরফ্যাশন শাখা থেকে শতশত কোটি টাকা লোপাট ও পাচারের আর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তদন্তে মাঠে নেমেছে দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখা-২-এর কর্মকর্তাদের চলমান অনুসন্ধানকালে দুদক চেয়ারম্যানের দফতরে নতুন আরও শত শত কোটি টাকা লোপাটের ও পাচারের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ব্যাংকের চরফ্যাশন শাখার সাবেক ম্যানেজার রেজাউল কবির গত ২৪ জানুয়ারি দুদক চেয়ারম্যানের দফতরে দাখিলকৃত অভিযোগে বলেন, ভোলা-৪ আসনের এমপি জ্যাকব তার ভাই ও ভাতিজা ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বেআইনিভাবে মধুমতি ব্যাংক চরফ্যাশান শাখা থেকে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে নামে তোমধ্যে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।

এসব প্রতিষ্ঠান লেনদেন করেন এমপি জ্যাকব তার বাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভ, ভাতিজা তরিকুল ইসলাম শরীফ ও পরিবারের সদস্যরা। এসব প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্য লেনদেন ও অপ্রদর্শিত আয় লেনদেন করা হয়। দুদকে দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়, মধুমতি ব্যাংক চরফ্যাশন শাখায় অ্যাকাউন্টকৃত সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে ইতোমধ্যে বৈধ ও অবৈধভাবে সম্পর্কে তিন থেকে চার হাজার কোটি টাক লেনদের হয়েছে। ১৩ জানুয়ারি ঢাকা থেকে যায় অডিট ও ইন্সপেকশন টিম। তারা গিয়ে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পায়।

মধুমতি ব্যাংকের চার ফ্যাশন শাখার সাবেক ম্যানেজার মো রেজাউল কবির লিখিতভাবে এমপি জ্যাকব তার ভাই সৌরভ, ভাতিজা তরিকুল ইসলাম শরীফ, ঐ শাখার কর্মরত সহকারী অফিসারের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। ঐ অভিযোগে তিনি বলেন এমপি জ্যাকব ও তার পরিবারের সদস্যরা ইচ্ছেমাফিক মধুমতি ব্যাংকের এই শাখাটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঐ শাখার ম্যানেজারকে জিম্মি করে ব্যাংকের ক্যাশ থেকে প্রতিদিনই ৫ থেকে ১২ কোটি টাকা নিয়ে তাদের বিকাশ পেমেন্টের চাহিদা পূরণ করা হতো। কিন্তু অধিকাংশ সময় উক্ত টাকার বিপরীতে কোন চেক দিতেন না তারা। তবে মাঝে মধ্যে সকালে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যেতেন বিকেলে কিছু টাকা ফেরত দিতেন। ম্যানেজার রেজাউল কবির এতে আপত্তি জানাতেন। কিন্তু এমপি জ্যাকব নিজে ও তার ভাতিজা ব্যাংকের সহকারী আফিসার তরিকুল ইসলামের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে লেনদেনগুলো অব্যাহত রাখতেন। এদিকে এমপির ভাতিজা তরিকুল ইসলাম আবারও ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নেন। বিকেলে ফেরত দেয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত তা ফেরত দেননি। এমনকি ঐ টাকার বিপরীতে কোনো চেকও দেননি। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করায় সাবেক ম্যানেজার রেজাউল কবিরকে হুমকি দেয়া হয়।

অভিযোগে আরও বলা হয় মিলন ট্রেডার্সের মালিক এমদাদুল হক মিলন এমপি জ্যাকবের নির্বাচনি এলাকার দুইটি উপজেলা একটি পৌরসভা ও ৪টি থানায় সরকারি বাজেট বরাদ্দকৃত কাজের বন্টন ও বন্টনকৃত কাজের কমিশন এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব কাজের কমিশনের সাদা ও কালো টাকা মিলন ও এমপির ভাতিজা তরিকুল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করে থাকেন।

গত বছর অক্টোবর ও নবেম্বর মাসে দুদকের টীম ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুল্লা আল ইসলাম জ্যাকবকে শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপরও হঠাৎ করেই আলোচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেন অস্বাভাবিকভাবে কমিয়ে দেয়া হয়। এর বেশির ভাগ লেনদেনই হাজার টাকার নোটে ট্রাভেল ব্যাগের মাধ্যমে হ্যা- ক্যাশ করে ঢাকা এনে শত শত কোটি টাকা পাচার করা হয়।

২০ জানুয়ারি ব্যাংক শাখার সাবেক ম্যানেজার মো: রেজাউল কবির ভোলা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের কাছে এমপি জ্যাকব ও তার পরিবারের সদস্যদের এই দুর্নীতি অভিযোগ প্রকাশ করেন। এসব অভিযোগ স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশেল পর রেজাউল কবিরকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এ বিষয়ে ২৩ জানুয়ারি রেজাউলের স্ত্রী নূর জাহান বেগম ভোলা সদর থানায় একটি জিডি করেন।

সংক্ষেপে সরকারি দল নিয়ন্ত্রিত বা তাদের মালিকানাধীন একটি ব্যাংক শাখার এই হলো হাল। মধুমতি ব্যাংকের চর ফ্যাশন শাখার এমনি চিত্র হলেও অনুসন্ধান করলে একই ধরনের চিত্র অন্যত্রও পাওয়া যাবে বলে মনে করা হয়। এ সব ব্যাংকের লস কেলেঙ্কারিও সীমাহীন। আর এসব কারণে এর আগে বন্ধ হয়েছে সরকার দলের সাবেক মন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন ফারমার্স ব্যাংক। এখন তা পদ্মা ব্যাংক নামে চালু রাখার চেষ্টা আছে।

মধুমতি ব্যাংকের চরফ্যাশন শাখায় যা ঘটছে বলে অভিযোগ, তা কোনো ব্যাংক শাখায় ঘটতে পারে না। কার্যত ঐ ব্যাংক শাখা এখন আর ব্যাংক নেই, তা যেন একটি মুদি দোকানের ক্যাশ বাক্সে পরিণত হয়েছে। আমরা অপেক্ষা করছি, দুদকের তদন্তে কী বের হয়ে আসে তা দেখার জন্য।

https://dailysangram.com/post/442074