২৮ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:০৪

ভয়ংকর মাদক 'আইস' ছড়াচ্ছে নিঃশব্দে

ঢাকায় এ পর্যন্ত চারটি চালান জব্দ। বাজার বড় করার চেষ্টায় কারবারিরা - ঠেকানো না গেলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ

নব্বই দশকের শেষ দিকে দেশে মাদক হিসেবে ইয়াবা সেবন চললেও ২০০২ সালের দিকে তা ধরা পড়ে। যদিও শুরুর দিকে এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না প্রশাসনের। সেই ইয়াবাই এখন মাথাব্যথার বড় কারণ। ২০১৯ সালের শুরুর দিকে দেশে আরেক ভয়ংকর মাদক 'আইস' বা 'ক্রিস্টাল মেথ'-এর অস্তিত্ব মিললেও তা বন্ধ করা যাচ্ছে না। বরং প্রথম চালান জব্দের পর গত দুই বছরে ঢাকাতে এই মাদকের আরও তিনটি চালান ধরা পড়েছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, নিঃশব্দে ভয়ংকর প্রাণঘাতী এই মাদক আইস ছড়িয়ে পড়ছে।

উপাদান পুরোনো হলেও আইস নামের এই মাদককে দেশে নতুন হিসেবে বলে আসছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা। তারা এও বলছেন, আপাতত কম ছড়ালেও এর বিস্তার ধ্বংস করা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। ছড়িয়ে পড়লে ইয়াবার মতো আইসের আগ্রাসনও থামানো কষ্টকর হবে। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবার সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে।

মাদকের পরীক্ষাগার সূত্রে জানা গেছে, আইস ইয়াবারই নতুন এক সংস্করণ। দুটিই মিথাইল অ্যামফিটামিন দিয়ে তৈরি। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করা ইয়াবায় সাধারণত অ্যামফিটামিন থাকে পাঁচ ভাগ এবং আসল ইয়াবায় সেটা পাওয়া যায় ২০ থেকে ২৫ ভাগ পর্যন্ত। কিন্তু আইস পুরোটাই অ্যামফিটামিন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা সমকালকে বলেন, আইস ইয়াবার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ক্ষতিকর মাদক এবং এটা মানবদেহে বেশি পরিমাণে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এজন্যই এটি ভয়ংকর।

তিনি বলেন, ইয়াবাও ধীরে ধীরে ছড়িয়েছিল। ৯০ দশকের শেষ দিকে দেশে ইয়াবা সেবন শুরু হয়। ২০০২ সালে এসে পরীক্ষায় ইয়াবার অস্তিত্ব ধরা পড়ে। ততদিনে সেটা ছড়িয়ে পড়েছিল। নতুন মাদক আইস এখনও পর্যন্ত সেভাবে ছড়াতে পারেনি। ধনী পরিবারের সন্তানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ছড়িয়ে পড়লে তা ভয়াবহ হবে।
অপর একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, ইয়াবা শুরুর দিকে উচ্চবিত্তের পরিবারের সন্তানদের মাদক ছিল। এখন সেটি একজন রিকশাচালকও সেবন করেন। আইস নিয়ে ধরাপড়াদের
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আইস অনেক দামি এবং এটি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের কাছেই পাওয়া যাচ্ছে। যদিও গত ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর হাতিরপুল ও হাতিরঝিল এলাকায় ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে আইসসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। ওই চারজনই মাদকের কারবারি ছিল। এজন্য আইসের বিস্তার যে ছড়াচ্ছে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মো. মোসাদ্দেক হোসেন রেজা সমকালকে বলেন, দেশে আইস বিস্তার ঘটেছে, সে কথা এখনই বলা যাবে না। তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী দেশে এর ব্যবহারকারী নেই বললেই চলে। বিদেশে থাকে, এমন কেউ কেউ দেশে এসে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এনে এটা ব্যবহার করছে। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সংস্থাগুলো এই মাদক নিয়ে সতর্ক থাকাতেই মাঝেমধ্যে এটা ধরাও পড়ছে।

তিনি বলেন, নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলোতে আইসের ব্যবহার সেভাবে নেই। এজন্য এটা দেশের জন্য আপাতত স্বস্তির বিষয়। তবে থ্যাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে মাদক হিসেবে আইসের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে এর বিস্তার ঠেকাতে তারাও সতর্ক রয়েছেন।

যে কারণে ভয়ংকর মাদক আইস :আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ডিএনসি সূত্র জানায়, আইস মিথাইলের সঙ্গে শতভাগ অ্যামফিটামিন থাকায় এটা বিশ্বজুড়েই ভয়ংকর মাদক হিসেবে চিহ্নিত। দেশে এখনও আইস সেবনকারী কেউ চিকিৎসা নিয়েছে বলে তথ্য যেমন নেই, তেমনি এই ধরনের মাদকের সেবনকারীর ওপর গবেষণাও হয়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া আইস বহনকারী ও ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং এটিতে ইয়াবার শতভাগ উপাদান থাকায় এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক আ ব ম ফারুক সমকালকে বলেন, এমননিতেই ইয়াবা আসক্তরা নানা উপসর্গে ভুগে থাকে। শতভাগ অ্যামফিটামিনযুক্ত মাদকে ভয়াবহভাবে দৈহিক ও মানসিক ক্ষতি যে হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এটা দেশে ছড়ানোর আগেই কড়া নজরদারি বাড়াতে হবে। এটা ইয়াবার মতো ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলছিলেন, পুরোটাই অ্যামফিটামিন হওয়ায় এটি সেবনের পর মানবদেহে অতি অল্প সময়ে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। এই মাদক সেবনে মস্তিস্কের রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এটি হৃদযন্ত্র, কিডনি ও লিভারেরও ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে। এক কথায় এটি দ্রুত মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

দেশে ছড়ানোর শঙ্কা :মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, ইয়াবার মতোই সহজে আইস বহন করা যায়। এখনও আকাশপথেই ব্যক্তি পর্যায়ে অল্প আকারে এটা আসছে। এজন্য বিমানবন্দরগুলোতে ধরাও পড়ছে না। দায়িত্বরত অনেকের কাছে এই মাদক সম্পর্কে ধারণা না থাকায় এটা দেশে ঢুকে পড়ছে। ক্রমেই এটা ছড়ানোর আশঙ্কা করছে পুলিশ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ডার্কনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আইসের মতো মাদকের চালান দেশে আনার তথ্য রয়েছে। এই ডার্কনেট নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও এই মাদকের চালান আসার তথ্য রয়েছে। তা ছাড়া মাদকের কারবারিরা নতুন নতুন মাদক ছড়াবে- এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এর বাইরে মাদক হিসেবে আইসের দাম অনেক বেশি হওয়ায় তা ছড়াতে কারবারিদের লোভটাও বেশি হবে।

আইসের বাজার তৈরির চেষ্টায় কারবারিরা :২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে প্রথম আইস নামের মাদকের অস্তিত্ব মেলে। ওই সময়ে আইসসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এরপর ওই বছরের ২৭ জুন খিলক্ষেত এলাকা থেকে নাইজেরিয়ার এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করেন ডিএনসি কর্মকর্তারা। গত বছরের ৪ নভেম্বরে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া এলাকা থেকে আইসসহ গ্রেপ্তার হয় ৬ জন। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি হাতিরপুল ও হাতিরঝিল এলাকা থেকে আইসসহ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হয় আরও চারজন। তারা স্বীকার করেছে, দেশে এখনও আইসের চাহিদা বেশি নেই। ধনাঢ্য সন্তানদের কেউ কেউ এই অতি দামি মাদক সেবন করছে। তবে 'অল্পতেই বেশি দাম পাওয়ায়' তারা এটার 'বাজার বাড়ানোর' চেষ্টায় রয়েছে।

গত বছরের ৪ নভেম্বর ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের মধ্যে একজন পুরান ঢাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী চন্দন রায়। তার কাছ থেকে জব্দ করা হয় ৬০০ গ্রাম আইস। ওই সময়ে চন্দন রায় বলেছিলেন, এই মাদকের দাম বেশি। ছোট বাজার হলেও লাভ বেশি। এজন্য তার এক প্রবাসী স্বজনের মাধ্যমে স্বর্ণ গলানোর কেমিক্যালের কথা বলে বিদেশ থেকে তিনি আইস নিয়ে আসছিলেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা-উত্তর মেট্রো অঞ্চলের তৎকালীন সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম জিগাতলা থেকে প্রথম আইসের চালানটি ধরেছিলেন। তিনি বর্তমানে ময়মনসিংহে উপ-পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত। এই কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, জিগাতলার আইস প্রসেসিংয়ের ল্যাব মালিক হাসিবের হাত ধরেই দেশে ওই মাদক প্রথম আসে। সে মালয়েশিয়ায় পড়ালেখার সময়ে ওই মাদকরাজ্যে ঢোকে। পরে তা দেশে ছড়াতে চেয়েছিল। তাকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছিল, দেশে ইয়াবার ব্যাপারে সতর্কতা তৈরি হলেও আইসসহ নতুন মাদকগুলোর ব্যাপারে প্রশাসন কম জানে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দ্রুত টাকা আয়ের জন্যই বিদেশ থেকে আইস এনে বিক্রির পরিকল্পনা করছিল। এজন্য আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিদের সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগও ছিল।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ সমকালকে বলেন, আইসসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর এই মাদকের বিষয়ে তারা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন। এই ধরনের ভয়ংকর মাদক যাতে কেউ ছড়াতে বা সেবন করতে না পারে, সেজন্য তারা সতর্ক রয়েছেন।
কারা কিনছে এই মাদক :অবৈধ পণ্যের কোনো বাজারদর না থাকলেও এই মাদক ব্যবহারকারীদের গ্রেপ্তারের পর ডিএনসি ও পুলিশ বলছে, আইস অতি উচ্চমূল্যের মাদক। গত নভেম্বরে ৬০০ গ্রাম আইসসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার জানিয়েছিলেন, ১০ গ্রাম আইসের দাম এক লাখ টাকা। তাই এটা এখনও উচ্চবিত্তদের মাদক হিসেবে চিহ্নিত। আইস ছাড়াও এটা 'সেবু', 'ডি ম্যাথ' নামেও সেবনকারীদের কাছে পরিচিত।

https://samakal.com/bangladesh/article/210150963/