২৮ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১১:০৩

কেন্দ্রের ভেতর-বাহির ক্ষমতাসীনদের দখলে

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ও চারপাশের কয়েক শ গজ এলাকায় গিজগিজ করছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর সমর্থকরা। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রতিটি কেন্দ্রেই তাঁরা পালা করে ভেতরে ও বাইরে অবস্থান করেন। ভোটের দিনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও বিএনপির কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর কর্মী ও সমর্থকরা ছিলেন একেবারেই কোণঠাসা। গতকাল বুধবার ভোটের দিনে সকাল থেকে নগরীর ৯, ১০, ১১ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্রগুলো ঘুরে এমন ছবিই চোখে পড়েছে। চারটি ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্রগুলোতে নানা অনিয়মও নজরে আসে।

সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ঈদগাহ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে শখানেক মানুষকে তাড়া দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় পুলিশ। কেন্দ্রটির ফটকের সামনেই হাতে বেশ কিছু কাগজ নিয়ে অসহায়ের মতো একবার পুলিশ ও একবার সেখানে উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাচ্ছিলেন বিএনপির কাউন্সিলর পদপ্রার্থী শামসুল আলম। এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আমার এজেন্টদের পরিচয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভেতরে অবস্থান করছেন। আমি যে এজেন্টদের তালিকা দিয়েছিলাম তারা সবাই বাইরে।’

সাবেক তিনবারের কাউন্সিলর ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি শামসুল আলমকে সে সময়ে ম্যাজিস্ট্রেট শ্যামানন্দ বলেন, ‘ভেতরে আপনার একজন এজেন্ট আছে তো।’

কেন্দ্রটির বুথগুলোতে শামসুল আলমের পোলিং এজেন্ট আছেন কি না, যাচাই করতে কেন্দ্রে ঢুকতে চাইলে প্রধান ফটকেই বাধা দেন সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা। তাঁরা বলেন, ‘কোনো সাংবাদিককে কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়ার অনুমতি নাই। আপনারা ভেতরে যেতে পারবেন না।’

কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. আশরাফুল হককে মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি পুলিশ দেখছে। আমার কিছু করার নেই।’ বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর এজেন্ট না থাকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি।’

সকাল সাড়ে ৯টার একটু পরে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের আরেকটি কেন্দ্র ভেলুয়ার দীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েও আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাড়া অন্য কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। কেন্দ্রের বাইরে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর পদপ্রার্থী সাবের আহম্মেদের সমর্থকরা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী নুরুল আমিনের লোকেরা কেন্দ্র থেকে অন্য প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট বের করে দিয়েছে।

কেন্দ্রটির ভেতরে প্রবেশ করার পর স্কুল ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রিসাইডিং অফিসার আব্দুল মোনায়েমকে পোলিং এজেন্টদের বেশ কয়েকটি ফরম হাতে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে আলাপ করতে দেখা যায়। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একাধিক প্রার্থীর ছয়জন পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কারণ তারা যে ফরম জমা দিয়েছেন তাতে আমার সই ছিল না।’ স্বাক্ষরহীন ফরম পোলিং এজেন্টরা কোথায় পেলেন, জানতে চাইলে আব্দুল মোনায়েম বলেন, ‘তারা হয়তো আমার টেবিল থেকে সই করার আগেই নিয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু তাদের জমা দেওয়া ফরমে আমার সই নেই তাই তাদের বের করে দেওয়া হয়েছে।’

সকাল ১০টা ৭ মিনিটে নগরীর কাট্টলী নুরুল হক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রটির বাইরে ভোটারের বেশ বড় লাইন। কিন্তু ভেতরে ভোটার নেই বললেই চলে। কেন্দ্রটির ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দেয় সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ। খানিকটা অপেক্ষার পর ভেতরে ঢোকার জন্য কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার জাহেদুল ইসলামের অনুমতি মেলে। স্কুল ভবনের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, ভোট চলছে এমন প্রতিটি কক্ষের সামনেই ১০-১৫ জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। বুথের পাশে একজন করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ভোট দেওয়ার গোপন বুথে নজরদারি করছে।

সকাল সোয়া ১০টার দিকে কাট্টলী নুরুল হক প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রটিতে শ দুয়েক মানুষ হৈচৈ করতে করতে ঢুকে পড়ে। তাদের অনেকের মাথায় সবুজ টুপি এবং গলায় নৌকার ব্যাজ ঝোলানো ছিল। প্রিসাইডিং অফিসারের পাশের ভোটকক্ষের সামনে জনা বিশেক মানুষ এসে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনেই বলতে থাকে, ‘ধানের শীষের এজেন্টদের বের করে দে।’ কর্তব্যরত এক আনসার সদস্যকে ধমক দিয়ে বলে, ‘তোরা থাকতে কিভাবে এখানে ধানের শীষের এজেন্টরা থাকে।’ এ সময় দুজন ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে গিয়ে তাঁদের যেন বের করে না দেওয়া হয়, সেই অনুরোধ করেন। এ সময় প্রিসাইডিং অফিসার তাঁর অসহায়ত্বের কথা জানান।

ভোট দিয়ে বের হচ্ছেন, এমন একজনের কাছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি প্রথমবারের ভোটার। ভোট দিতে বুথে গিয়ে দেখি ভেতরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমি শুধু কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দিতে ইভিএম মেশিনের বাটনে চাপ দিতে পেরেছি। বাকি দুইটা বাটনে চাপ বুথের পাশে দাঁড়ানো ওই ব্যক্তিই দিয়েছেন।’

সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়তলী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রটির বাইরে এবং স্কুলের মাঠে ৮-১০ জন করে মানুষের জটলা। প্রধান ফটকে ৪০-৫০ জন কিশোর দাঁড়িয়ে। তাদের একজন আহমদ মিয়ার কাছে সেখানে অবস্থান করার কারণ জানতে চাইলে খানিকটা দূরে আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলে, ‘ওই যে ওদের দেখছেন, ওরা বিএনপির লোক। ওদের এদিকে ঢুকতে দেব না।’

কেন্দ্রটির দ্বিতীয় তলায় প্রিসাইডিং অফিসার মো. জসিমউদ্দিনের কক্ষে গিয়ে কথা হয় ভোটগ্রহণের সার্বিক বিষয়ে। তিনি বলেন, কেন্দ্রটিতে মোট ভোটার এক হাজার ৭৪৩। সকাল ১১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত প্রথম তিন ঘণ্টা ২০ মিনিটে ভোট পড়েছে ১০ শতাংশের মতো।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/01/28/999399