২৮ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৪

ব্যাপক সহিংসতার মধ্যদিয়ে চসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত

চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে লালখান বাজার এলাকায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও মারামারিতে রক্তাক্ত শাহাদতকে রিকশায় করে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিচ্ছেন সহকর্মীরা

সংঘর্ষ, হামলা, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ভাংচুরসহ বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ ঘটনার মধ্যদিয়ে গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে সংঘর্ষে দুইজন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ জানিয়েছে, বিভিন্ন স্থান থেকে গুরুতর আহত ৩০ জন ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছে।

নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রাথীর সমর্থকদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, কেন্দ্রগুলোতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে উত্তেজনাকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে এ সংঘর্ষ, হামলা, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ভাংচুরের ঘটনাগুলো ঘটে বলে স্থানীয় লোকজন জানায়। তারা বলছে, স্থানীয় লোকজনের চেয়ে বহিরাগতরা সংঘর্ষগুলোতে অংশ নিয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত ঘটনাস্থলগুলোতে এ্যাকশনে যাওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনের দিন প্রচুর বহিরাগত দেখা গেছে। নগরবাসী বলছে, এবার চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের দিন সরকার সাধারন ছুটি ঘোষণা না করায় বিভিন্ন উপজেলা, আশেপাশের জেলা থেকে আগত বহিরাগতদের বহিরাগত বলে চিহ্নিত করা যায়নি। এটি কৌশল। বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারের চেয়ে বহিরাগতদের উপস্থিতি বেশি ছিল। মনে হচ্ছিলো প্রচুর ভোটার উপস্থিতি। নগরীর বেশিরভাগ কেন্দ্রে সকালে ভোটার ছিল কম বহিরাগত ছিল বেশি। ভোটারের চেয়ে তাদের আগ্রহ ছিল বেশি। কেন্দ্রে সকাল থেকে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। মিডিয়াকে দেখানোর জন্য বহিরাগতরা ভোটার হিসাবে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটার উপস্থিতি বেশি দেখানোর চেষ্টা করে। একজন ভোটার ক্ষোভের সাথে বলেন, ভোটারের চেয়ে বহিরাগত বেশি। কেন্দ্রের সামনে বহিরাগত জড়ো করে রাখার প্রবনতা শুরু হয়েছে গত মেয়র নির্বাচন থেকে। যার কারণে ভোটার কেন্দ্রে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। সচেতনরা বলছে, সামনে নির্বাচনগুলোতে ভোট কেন্দ্রের আশেপাশে বহিরাগতদের উপস্থিতি ঠেকাতে আইন করা উচিত। তাহলে সংঘাত বন্ধ হবে।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন চলাকালে প্রায় সব কয়টি কেন্দ্র থেকে ভোটার ও এজেন্টদের বের করে দিয়ে নেতাকর্মী ও কাউন্সিল প্রার্থীর উপর মামলা, বহিরাগত ভোটার দিয়ে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলেছেন বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বুধবার সকালে বাকলিয়া বিএডস্থ নিজ কেন্দ্রে ভোট দিতে এসে বলেন, ভেবেছিলাম এ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ভোটের সংস্কৃতি ফিরলেও ফিরতে পারে। হয়তো মানুষ ভোটাধিকার পাচ্ছে এর মধ্যদিয়ে। কিন্তু আমরা এ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির নগ্নতা দেখতে পাচ্ছি। ডা. শাহাদাত হোসেন পৌনে ১০টার দিকে ভোট দিতে এসে এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আমার কেন্দ্র থেকে এজেন্টে বের করে দেয়া হয়েছে। ভোট ডাকাতিতে প্রশাসন যন্ত্র ও রাষ্ট্র যন্ত্র মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। জামাল খান ওয়ার্ডে আমাদের ওয়ার্ড কাউন্সিল প্রার্থীকে হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রে নারী এজেন্টদের মারধর করা হয়েছে। তাদের কেন্দ্রে ঢুকতেও দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, এখন নির্বাচনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে প্রশাসনের সাথে। রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে ভোট হচ্ছে। ভোট ডাকাতিতে প্রশাসন রাষ্ট্রযন্ত্র আওয়ামী লীগ একাকার হয়ে গেছে।
ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, নাসিরাবাদ সিএন্ডবি সেন্টার থেকে ৫ এজেন্টকে বের করে দিয়েছে। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে বাধার শিকার হচ্ছে। আমাদের এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়নি। পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েছিলাম। তারা বলছে আমরা কিছু করতে পারবো না। তবে আমরা ভোট বর্জন করবো না সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখবো। তার পর আওয়ামী লীগের ভোট ডাকাতির মুখোশ তুলে ধরবো বিশ্ব মিডিয়ার কাছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরী নিজের ভোট দিয়ে বলেছেন, তিনি জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। তবে জয়-পরাজয় যা-ই হোক, তিনি তা মেনে নেবেন। বুধবার সকাল পৌনে নয়টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটের এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন রেজাউল করিম চৌধুরী। তাঁর বাড়ির পাশের কেন্দ্র এটি। এ সময় তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ অন্য নেতারা ছিলেন।ভোট দেয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভোট সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি রয়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট থাকা ও তাদের এজেন্টদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির বিষয়ে রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি অভিযোগের পার্টি। সাংগঠনিক অবস্থার কারণে তাদের লোক নেই। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে এজেন্ট দিতে পারেনি।’

১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে গুলীবিদ্ধ এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার সকালে পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ইউসেফ আমবাগান টেকনিক্যাল স্কুল ভোটকেন্দ্রে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নিহত ওই যুবকের নাম আলাউদ্দিন (২৮)। তিনি কুমিল্লা জেলার সুলতান মিয়ার ছেলে। স্থানীয়রা জানান, সকালে ভোটগ্রহণ শুরুর পর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ওই ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী এবং বিদ্রোহী প্রার্থী মাহামুদুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলীবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন আলাউদ্দিন। তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সংঘর্ষে আরও ৪ জন আহত হয়েছেন। একটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার পর ঝাউতলা এলাকায় রেললাইন অবরোধ করে রাখে মাহমুদুরের সমর্থকেরা।

এদিকে পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ বার কোয়ার্টার এলাকায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন হয়েছেন। দুই ভাই দুই কাউন্সিলর প্রার্থীকে সমর্থন করতেন। বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, দুই ভাইয়ের মধ্যে পূর্ব থেকে বিরোধ ছিল। নিহতের নাম নিজাম উদ্দীন মুন্না। অভিযুক্ত তার ভাই সালাউদ্দীন কামরুল। এদের মধ্যে নিজাম উদ্দীন মুন্না সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাবের আহমদের সমর্থক ও অভিযুক্ত সালাউদ্দীন কামরুল আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নুরুল আমিনের সমর্থক। স্থানীয়রা বলছে, সকালে ভোট শুরুর আগেই দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হলে মুন্নাকে ছুরিকাঘাত এবং গলাকেটে হত্যা করে পালিয়ে যায় কামরুল। পুলিশ মুন্নার লাশ উদ্ধার করেছে।পাহাড়তলী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রাশেদুল ইসলাম বলেন, বার কোয়ার্টার এলাকায় ছুরিকাঘাতে নিজাম উদ্দীন মুন্না নামে একজন নিহত হয়েছে। তার ভাই সালাউদ্দীন কামরুল ছুরিকাঘাত করেছে বলে জানতে পেরেছি। তিনি বলেন, মুন্না ও সালাউদ্দীন কামরুলের মধ্যে পূর্ব থেকে বিরোধ ছিল। অভিযুক্তকে আটকের চেষ্টা চলছে।

লালখান বাজার এলাকায় বুধবার সকাল থেকে দফায় দফায় নির্বাচনী সংঘর্ষে ২১ জন আহত হয়েছে বলে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর দাবি।বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, ওই ওয়ার্ডের ১৪টি কেন্দ্রের মধ্যে সবগুলো ‘দখল’ করে নিয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন। আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর দাবি, তার অনুসারীদের ওপর হামলা হয়েছে বিএনপি প্রার্থীর নেতৃত্বে। ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ভোটে আছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবুল হাসনাত বেলাল। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক কাউন্সিলর এফ কবির মানিক। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সকাল নয়টার দিকে শহীদ নগর সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে বেলালের সমর্থকদের সঙ্গে মাসুমের সমর্থকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এ সময় হকিস্টিক, লাঠি নিয়ে হামলা চালানো হয়।কাচের বোতল, ইটপাটকেল ছোড়া হয় এলোপাতাড়ি। বিজিবি-পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে সকাল ৯টায় এ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদ। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবদুল হালিম শাহ আলম বলেন, “কোনো কেন্দ্রেই মেয়র ও আমার এজেন্ট ঢুকাতে পারেনি। তারা আমাকেও শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে। আমাদের ১৫ জন আহত হয়েছে। গতরাতে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাণ্ডব চালিয়ে মতিঝর্ণা, পোড়া কলোনি ও লালখানবাজার এলাকায় প্রত্যেক সেন্টার তারা দখল করে নিয়েছে। ১৪টি কেন্দ্রের একটিতেও আমাদের এজেন্ট নেই।
এদিকে পাথরঘাটা ওয়ার্ডে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষের জের ধরে দুটি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। লাঠিসোঁটা নিয়ে কয়েকশ’ উত্তেজিত নারী-পুরুষ ভোটকেন্দ্রে হামলা চালায়। তারা ইভিএম মেশিন, কেন্দ্রের দরজা-জানালা ও নিরাপত্তারক্ষীদের গাড়ি ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ১০টি ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। বুধবার সকালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরু হলে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের পাথরঘাটা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সেখানে তিনজন প্রার্থী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থনে পুলক খাস্তগির এবং বিএনপির সমর্থনে মো. ইসমাইল কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বেলা ১১টার দিকে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকেরা কয়েকটি বুথ দখল করে জাল ভোট দিচ্ছে। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এর পরপরই ৫০০ থেকে ৬০০ উত্তেজিত নারী-পুরুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে ভোটকেন্দ্রে হামলা চালায়। তারা ভোটকেন্দ্রের সামনে রাখা পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত মিনিবাস ভাঙচুর করে। কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে পাঁচটি ইভিএম মেশিন এবং কক্ষের দরজা ও জানালার কাচ ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ১০টি ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। পুলিশ বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মো. ইসমাইলকে আটক করেছে। এদিকে সকাল ১০টার দিকে আছাদগঞ্জ সোবহানিয়া মাদরাসা এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
ফিরিংগী বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী মোঃ সালাহউদ্দিন ও বিদ্রোহী প্রার্থী হাসান মুরাদ বিপ্লবের সমর্থকদের মধ্যে দুপুর দেড়টার পর আর সি চার্চ রোড, ব্যাপটিস্ট মিশন রোডে সাবিত্রী সুধা প্রাইমারী স্কুল ও জে এম সেন স্কুল কেন্দ্রের সামনে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে দুই গ্রুপের মধ্যে। এই সময় লাঠি, ইটের আঘাতে ৫জন আহত হয়।এক পর্যায়ে বিজিবি, পুলিশ এসে সংঘর্ষকারীদের ধাওয়া দেয়। ফাকাঁ গুলি ছুঁড়ে। ব্যাপক পুলিশী তৎপরতায় পরে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

১৪, ১৫ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী মনোয়ারা বেগম মনি নিজের ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার দলীয় সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেননি। প্রতিবাদে মনোয়ারা বেগম মনি নির্বাচন বর্জন করেছেন। বুধবার দুপুর ১২টা ১০ মিনিটের দিকে লালখানবাজার মোড়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মনোয়ারা বেগম মনি। এসময় তিনি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।মনোয়ারা বেগম মনি অভিযোগ করেন, আমি নিজের ভোটই দিতে পারিনি। আমার এজেন্টদের মেরে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা হয়েছে। মনোয়ারা বেগম মনি তার মতো সব বিএনপির প্রার্থীকেও নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, এখনই এ নির্বাচন স্থগিত করতে হবে।

এদিকে ৯ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডের বিশ্ব কলোনির পি ব্লক কোয়াক স্কুল ভোট কেন্দ্রের দখল নিতে গিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয়রা সাংবাদিকদের জানান। ঘটনার পর বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে তুলে নিয়ে যায় পাহাড়তলী ওয়ার্ডের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী জহুরুল আলম জসিমকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ২টার দিকে ৯ নং এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবছার মিয়া এবং বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের অনুসারীদের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।

এদিকে ৪ নং চান্দগাঁও ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র সচিবকে দুর্বৃৃত্তরা কুপিয়ে আহত করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, চান্দগাঁও থানার মৌলভী পুকুর পাড়স্থ গ্রিন সাইন স্কুল কেন্দ্রে যান নৌকার কেন্দ্র সচিব শাহাবুদ্দিন সান্টু (৪৫)। এ সময় সেখানে প্রতিপক্ষের ২০-২৫ জনের একটি দল ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে তাকে কুপিয়ে জখম করে। এতে সান্টু গুরুতর আহত হন। দ্রুত পুলিশ এসে রক্তাক্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ইলিয়াস নামে আরো একজন আহত হয়েছে। বর্তমানে তারা দুজনই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

মহানগর যুবদলের সভাপতি মোশারফ হোসেন দীপ্তি সকাল সাড়ে ৯টায় অভিযোগ করে বলেন, সকাল থেকেই নগরীর বিভিন্ন কেন্দ্র নিজেদের দখলে নেয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। তারা লালখান বাজার, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড, ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ড, ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ডে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টরা ঢুকতে চাইলে বহিরাগতরা বাধা দেয়। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ঝোলাপাড়া, ফিরোজশাহ কলোনি, রামপুরের মতিঝর্ণাসহ পাহাড়তলী ও লালখান বাজারের বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে এরকম ঘটনা ঘটেছে।

পাঠানটুলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরের লোকজন জানান, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের অনেক কেন্দ্রেই কাউন্সিলর প্রার্থী আব্দুল কাদেরের এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। সেখানে যাওয়া ভোটারদেরও ভেতরে যেতে দেয়া হচ্ছে না। এসব কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে- কমার্স কলেজ, কদমতলী আবেদীয়া স্কুল, পাঠানটুলী স্কুল, পালকি কমিউনিটি সেন্টার ভোটকেন্দ্র। কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই পাহারা দিচ্ছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের সমর্থকরা। কেন্দ্রের ভেতরে তাদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।

এদিকে চকবাজার ওয়ার্ডের কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন মহিলা কলেজ, কাতালগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ কেন্দ্রসহ কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে ভোট শুরুর দুই ঘন্টায় ভোটার ছিল কম। কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন মহিলা কলেজ ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ হাজার ১৬৬ জন। তবে সকাল ১০টা পর্যন্ত এই ভোটকেন্দ্রে ৩০টির মতো ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। এই কেন্দ্রে মাত্র ২ জন ভোটারের দেখা মিললেও কেন্দ্রের বাইরে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীদের জটলা দেখা গেছে। এ সময় যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনু তাদের দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

বিএনপির সাংবাদিক সম্মেলন
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন শেষে জরুরী সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন যেখানে নির্বাচনই হয়নি সেখানে ভোট বর্জন কিংবা প্রত্যাখানের প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, আজ বুধবার চট্টগ্রামে কোন নির্বাচনই হয়নি। নির্বাচনের নামে হামলা খুন সহিংসতা ভোট ডাকাতি হয়েছে। আর সন্ত্রাসীদের মিলন মেলা ঘটেছে। এটাকে নির্বাচন বলা যায় না। এটা মানুষের জীবন নিয়ে খেলা। বুধবার দিনভর ভোটগ্রহণ শেষে নগরীর নাসিমন ভবনের দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক জরুরি সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন- নির্বাচন কমিশন হচ্ছে কতগুলো তাবেদার সেখানে তাদের বসিয়ে দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের ভোট চুরি ডাকাতি সম্পন্ন করার জন্য। আমি তাদের বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।

সম্মেলনে বিএনপির ডা: শাহাদাত হোসেন বলেন-আমরা মনে করেছিলাম উৎসবমুখর পরিবেশে একটি নির্বাচন করবো। আমরা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নির্বাচনে অংশ নিয়ে ছিলাম। কিন্তু নির্বাচনটা আমাদের সাথে আওয়ামী লীগের হয়নি। নির্বাচন কমিশনকে আমরা তিনটি দাবি জানিয়েছিলাম। ইভিএম মেশিনকে সুরক্ষা, এনআইডি ছাড়া কেন্দ্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ও বহিরাগতদের ঠেকানো। কিন্তু সেটা হয়নি, আমাদের নির্বাচন হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে।দিনভর বিভিন্ন সেন্টার ঘুরে দেখেছি আমার ভোটার, এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে মারধর করে বের করে দিয়েছে। নারী এজেন্টদের শারিরিক নির্যাতন করে তাদের আহত করেছে। প্রতিটি সেন্টারে হাজার হাজার বহিরাগতদের অবস্থান দেখেছি। ২০০ নেতাকর্মী আটক করা হয়েছে। আজকের এ নির্বাচন নির্যাতনে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন থেকে নির্বাচন কমিশন থেকে আমরা কোন সহযোগিতা পায়নি। দিনভর কেন্দ্রে বহিরাগত আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রাজত্ব ছিল। প্রতিটা কেন্দ্রের বাইরে তারা হাজার হাজার বহিরাগতদের জড়ো করেছে। এবার ভোট ডাকাতির মাধ্যমে তাদের সে চেয়ারা আবার জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনে সাবেক মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, নাগরিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক একরামুল করিম চৌধুরী, নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাসেম বক্কর, দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, কেন্দ্রীয় সদস্য মীর হেলাল উদ্দিন, নগর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক এস এম সাইফুল আলম, এস কে খোদা তোতন, ইঞ্জি. বেলায়েত হোসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

রেজাউলের পক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন
ভিত্তিহীন নানা অভিযোগ তুলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে বিএনপি প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল। বুধবার দুপুরে বহদ্দারহাটে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরীর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে এমন অভিযোগ করেন তিনি।

এডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, সকাল থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়েছি। ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছি। ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসছেন। অথচ বিএনপির মেয়র প্রার্থী মিডিয়াকে ভোট ডাকাতি এজেন্টদের বাধা দেয়া হচ্ছে বলে মিয়িাকে মিথ্যাচার করে চসিক নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপির কর্মীরা বিভিন্ন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেছে। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আমাদের কাছে তথ্য আসছে। বিএনপির এতো ষড়যন্ত্রের পরও আমরা ভোটে রয়েছি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে আমরা বিশ্বাসী। তিনি বলেন, পুলিশ লাইন্স স্কুল কেন্দ্রে বিএনপির কর্মীরা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ফারুকের ছেলে তানভীর ফয়সাল ইভানকে মারধর করেছে। চান্দগাঁওয়ে বিএনপির কর্মীরা আওয়ামী লীগের এজেন্টদের মারধর করেছে। এসময় উপস্থিত ছিলেন নগর আওয়ামী লীগ নেতা নোমান আল মাহমুদ, নজরুল করিম চৌধুরী প্রমুখ।

https://dailysangram.com/post/441954