২৬ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৭:১৬

স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা

|| আবুল আসাদ || আজকের পৃথিবীটা একটা গ্রামের মত। গ্রামরূপ বিশ্বের পরিবেশ-পরিস্থিতি বাড়িরূপ জাতি-রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করছে। যুদ্ধ, শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি সত্য। কোনো দেশে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলে তা দুনিয়াকে না পোড়ালেও উত্তপ্ত করে। ২০০১ সালে ধ্বংস হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার, তার ফলে বলা যায় বদলে গেছে গোটা দুনিয়ার পরিস্থিতি। আফগান ও ইরাক যুদ্ধ গোটা দুনিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে। ছোট হয়ে যাওয়া এই পৃথিবীতে জাতিসংঘের ছায়ায় দাঁড়ানো জাতি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অনেক দিক থেকে আজ যেমন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিশ্চিত হয়েছে, তেমনি অপর কিছু দিক থেকে এই নিরাপত্তা বিরাট ঝুঁকির মধ্যেও পড়েছে। আগের মত কোনো দেশ অবশ্য আজ সরাসরি দিগ¦ীজয়ে নামছে না, শুধু শক্তির উপর ভিত্তি করে এক দেশ আরেক দেশকে আক্রমণ করে বসছে না। আগ্রাসনের অতীত এই চেহারা আজ পাল্টে গেছে। আজ অস্ত্রই শুধু দ্বিগ¦ীজয়ের হাতিয়ার নয়। বাণিজ্য, আর্থিক সাহায্য, কূটনীতি, মিডিয়া, সংস্কৃতি প্রভৃতিও আগ্রাসনের ক্ষেত্রে আজ অনেক বেশি বিপজ্জনক হাতিয়ার। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত ছোট রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তার দিক দিয়ে আজ জটিল অবস্থার সম্মুখীন। তার উপর বাংলাদেশ ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক যে পরিমন্ডল, তা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যে বাড়তি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক ভূখন্ড গঠনের পেছনে যে ঐতিহাসিক ঘটনা-পরম্পরা রয়েছে তাও বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রতি সব সময় আঙ্গুল উঁচিয়ে রয়েছে।
আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান, নতুন করে জাতিসংঘের গঠন বিশ্বের রাজনৈতিক চেহারা পাল্টে দেয় এবং আগ্রাসী হওয়ার মত শক্তিগুলোর চরিত্রেও পরিবর্তন নিয়ে আসে। এক দেশ আরেক দেশের উপর নেকড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়ার মত অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ৪৫ বছরের দীর্ঘ ঠান্ডা যুদ্ধকালে যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন তার ট্যাংকের তলায় হাঙ্গেরী ও পোলান্ডের স্বাধীন সত্বাকে পিষ্ট করেছিল, যদিও মার্কিন সৈন্য গ্রেনেডা ও হাইতিতে অবতরণ করেছিল এবং কিউবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েছিল, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত, চীন, কোরিয়া ও ভিয়েতনামে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল এবং লাখ লাখ মানুষের জীবন হরন করেছিল, এরপরও এই আগ্রাসনগুলো ছিল একক নয়, সামষ্টিক। দুই পক্ষে দুই ব্লক, পুঁজিবাদী ও কম্যুনিজম, আগ্রাসী শক্তির ভূমিকা পালন করেছে। তারাই দখল করে নিতে চেয়েছিল গোটা দুনিয়া। ১৯৯০ সালের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে কম্যুনিষ্ট ব্লকের বিলুপ্তি ঘটে এবং বিশ্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের একমাত্রিক প্রভাবের অধীনে চলে আসে। এ সময়ই আগ্রাসন আবার নতুন এই সামষ্টিক রূপ পরিগ্রহ করে। এখন জাতিসংঘের আমব্রেলা মাথায় পরে, কিংবা জাতিসংঘকে নিষ্ক্রিয় করে মিত্রদের পাশে রেখে জাতি রাষ্ট্রের উপর আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। আফগানিস্তান, ইরাক ও সুদানের সার্বভৌমত্ব পদদলিত করা এবং অনেক দেশের সার্বভৌম রাষ্ট্রিক সিদ্ধান্তের কন্ঠরোধের চেষ্টা এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত। এই আগ্রাসনে অগ্রবাহিনী হিসাবে অর্থনৈতিক অবরোধ এবং সামরিক সরঞ্জামের আদান-প্রদানে বিধি-নিষেধ আরোপকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই প্রত্যক্ষ আগ্রাসন, হস্তক্ষেপ ছাড়াও সাহায্য নামক অর্থনৈতিক শাসন, কূটনৈতিক চাপ, মিডিয়া সন্ত্রাস ও সাংস্কৃতিক প্রবেশ বা অনুপ্রবেশের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের ছোট ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্বল, ভীত ও অসহায় খাতকে পরিণত করা হচ্ছে।
এক কথায় আজকের দুনিয়ায় নেকড়ে ও মেষ শাবকের মধ্যে আক্রমণ ও আত্মরক্ষার অসম লড়াই চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব অতীত বিশ্ব ব্যবস্থায় নেকড়ে সরাসরি মেষ শাবককে ধরে খেয়ে ফেলতো, কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে নেকড়ে মেষ শাবকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার যুক্তি হিসাবে স্বকল্পিত কারণ সৃষ্টি করে এবং সে কারণকে বাহন সাজিয়ে মিত্রদের সাথে নিয়ে জাতিসংঘের সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় সমর্থনে অসহায় মেষ শাবকের ঘাড় মটকায়।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা:
বিশ্ব পরিস্থিতিগত উপরোক্ত নিরাপত্তা-সমস্যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও পুরোপুরি বর্তমান। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত সাহায্য নামক মাদক বাংলাদেশও নির্বিচারে গ্রহণ করেছে। যদিও সাহায্য নির্ভরতা আমরা অনেক কমিয়েছি, কিন্তু এখনও সাহায্য না হলে আমাদের চলছে না। চলতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ডোনারদের ইচ্ছা ও হুকুমের কাছে আমাদের জনস্বার্থ, রাষ্ট্রের চাহিদা, নিরাপত্তা প্রয়োজন প্রভৃতি কোনো কিছুর মূল্য থাকছে না। ভারতের ১ বিলিয়ন ডলার, পরে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ বাংলাদেশ গ্রহণ করার মূলে আমাদের আগ্রহের চেয়ে ভারতের প্রয়োজনই যেন বেশি কাজ করেছে। এর ফলেই নানা চাপে রাষ্ট্র বিরোধীদের ষড়যন্ত্রকে ‘অধিকার’ বা ‘মানবাধিকার হিসাবে মানা করে মাথায় তুলে রাখতে হচ্ছে, রাষ্ট্র ও জনগণের বিরুদ্ধে জলজ্যান্ত মিথ্যা অপরাদ ও অপপ্রচারকে ‘বাক স্বাধীনতা’ বলে স্বীকার করতে হচ্ছে, উড়ে এসে জুড়ে বসা ভূয়া ‘আদিবাসি’দের দাবীকে মানার জন্যে তাদেরকে ‘প্রকৃত আদিবাসি’ বলে স্বীকার করতে হচ্ছে, উড়ে এসে জুড়ে বসা ভূয়া ‘আদিবাসিদের দাবীকে মানার জন্যে ‘প্রকৃত আদিবাসি’ জনগণ ও দেশের সংবিধানের কন্ঠরোধ করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এইভাবে আমরা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তা বিপন্ন করছি।
বাংলাদেশের উপর এই পরিস্থিতিগত বিপদ ছাড়াও আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূখন্ডগত স্বাতন্ত্র্য লাভের শুরু থেকেই আমাদের বড় প্রতিবেশীর প্রবল বৈরীতা আমাদের তাড়া করে ফিরছে। এই ভূখন্ড যখন পূর্ব পাকিস্তান ছিল, তখনও এ বৈরীতা ছিল। একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করার পরও এই বৈরীতা তারা পরিত্যাগ করেনি। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগ ভারত মেনে নিয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান টিকে থাকুক তা চায়নি। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা সাহায্য করেছে, তাদের হাজার হাজার সৈনিক জীবন দিয়েছে এ যুদ্ধে, কিন্তু তারা চায়নি যে, বাংলাদেশ প্রকৃতই এক স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে পরিণত হোক। তারা আশা করেছিল, বাংলাদেশ সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের দ্বিজাতিত্বের দর্শন পরিত্যাগ করবে, মুসলিম পরিচয়কে পেছনে ঠেলে দেবে, দেশ বিভাগ তাদের কাছে ধীরে ধীরে অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক হয়ে দাঁড়াবে এবং একদিন রাষ্ট্রীয় সীমানা তাদের কাছে খুব প্রয়োজনীয় বলে মনে হবে না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তি এবং আমাদের স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকেই এ ধরনের কথা তারা শুরুও করে দেয়। ১৯৭৩ সালে কলকাতায় প্রকাশিত A.T. Dev-এর ডিকশনারীতে দেয়া ম্যাপে বাংলাদেশকে ভারতের একটা প্রদেশ হিসাবে দেখানো হয়। সেই সময় কলকাতার দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকায় তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘The Chief Minister of Bangladesh’ বলে অভিহিত করা হয়। এটা প্রকৃতই তাদের ভুল। কিন্তু এই ভুল তারা বারবারই করে আসছে। কলকাতার বিখ্যাত দৈনিক Statesman তার Reunion of India নিবদ্ধে লিখে.....now is the time of work for a United States of India with the merger of this country Bangladesh and....”। পরে কলকাতার আনন্দবাজার গ্রুপের ইংরাজী দৈনিক টেলিগ্রাফ Bangladesh are voting against partition with their feet’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবদ্ধে লিখে, “পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা ১৯৭১ সালে। এখন দ্বিতীয়বার তারা প্রত্যাখ্যান করছে দেশ বিভাগকে। পাকিস্তান ছিল প্রথম স্বপ্ন, দ্বিতীয় স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ যা রূপ পেয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রে। এই দ্বিতীয় স্বপ্ন বাংলাদেশকে তারা আজ প্রত্যাখ্যান করছে।”
টেলিগ্রাফ এর এ সম্পাদকীয়টি ছাপা হয় ১৯৯২ সালের ২৫ শে অক্টোবর সংখ্যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাপারে ভারতীয়রা একই ধারণা পোষণ করছে। এই ধরণের কথা তারা আরও বলেছে। ‘বাংলাদেশ এবং অতঃপর’ প্রবন্ধে নিরঞ্জন সেনগুপ্ত কলকাতার যুগান্তর, ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, সংখ্যায় লিখেন, “....জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ....এই সাথে সহজ হয়ে গেল আমাদের সীমান্ত রক্ষার সমস্যা।’ ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১, আনন্দ বাজার এক সম্পাদকীয়তে লিখে, “জাতিতত্বের উপাদান হিসাবে ধর্মান্ধতা এ উপমহাদেশে পরাস্ত হয়েছে। ....ভাগাভাগি মিথ্যে করে দিয়ে আবার এক প্রশস্ত সেতু থেকে সাংস্কৃতিক মৈত্রীর এবং সহযোগিতার গাঁথুনী ধরে রাখবে।” ভাগাভাগি মিথ্যে করার চাইতেও বড় কথা তারা বলে তারা বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষের ধর্ম ইসলামকে তারা টার্গেট করে। কলকাতার যুগান্তর, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১, সংখ্যায় তার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, “তার (ভারতের) সারা অঙ্গে রয়েছে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ছাপ। আদর্শের এই ঐক্য চেতনা ভারত ও বাংলাদেশকে টেনে এনেছে কাছাকাছি। ....তার হাতে পরিয়ে দিয়েছে সৌভ্রাতৃত্বের রাখি বন্ধন। দু’হাতে তাকে আড়াল করে রেখেছে ভারত। জমির লোভ নেই। আদার্শের জন্যে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার প্রস্তুত। বাংলাদেশ খুড়ছে অত্যাচারী স্বৈরতন্ত্রের কবর, তাতে ইসলামের শব নামাবে ভারত। আর এই কবরে মাটি দেবে ভারত ও বাংলাদেশের নর-নারী।” তাদের মতে বাংলাদেশের কোনো নিরাপত্তা চিন্তা নেই। তাই বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনও তারা দেখেনি। কলকাতার যুগান্তর, ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১, সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ রায় লিখে, “চারপাশে কোনো দিক থেকে বহিঃশত্রুর আক্রমণের আশংকা নেই। তাই অস্ত্র-শস্ত্র এবং সেনা-নৌ-বিমান বহর মোতায়েন রাখার .... কোনো প্রয়োজন হবে না। অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার জন্যে কিছু পুলিশ থাকলেই চলবে।” পরবর্তিকালে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের চিন্তা ও চাওয়া যেন আরও পরিপোক্ত হয়েছে। ২০০৫ সালের ২৪ এপ্রিল নিউইয়র্কে উভয় বাংলার শিল্পীদের অনুষ্ঠানে ভারতীয় অভিনেতা চিরঞ্জীত চট্টোপাধ্যায় বলেন, “দুই বাংলার সীমানা মুছে ফেলতে হবে। সীমানা চিহ্ন থাকবে না। আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক। আমরা একান্নবর্তি পরিবারের মতো বসবাস করতে চাই। এ স্বপ্ন আমাদের নেতারাও দেখতেন। এপার বাংলা ওপার বাংলা একাকার হতে এই অনুষ্ঠান দিয়ে যাত্রা শুরু হলো। অপেক্ষা করুন অদূর ভবিষ্যতেই সব দেখতে পাবেন।” অনুরূপ উক্তি ভারতীয় শিল্পীরা পরবর্তিকালে বাংলাদেশের অনুষ্ঠানে এসেও করেছেন। ফেসবুকে এর ভিডিও ক্লিপ আমি দেখেছি।
ভারতীয়রা এই কথাগুলো হয়তো আবেগ বশতঃই বলেছেন, কিন্তু তা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্যে খুবই উদ্বেগের। তাদের এই মানসিকতার কারণেই যেন বাংলাদেশের সাথে কোনো সমস্যার সমাধানেই তারা আসছে না। বাংলাদেশকে স্থায়ীভবে চাপের মধ্যে রেখে তাদের লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হওয়া তাদের একটা কৌশল হতে পারে। কলকাতার আজকাল পত্রিকায় ২২, ২৩ ও ২৪ এপ্রিল, ১৯৮৯, তারিখে প্রকাশিত এক ধারাবাহিক রিপোর্টে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র বিষয়ে নানা উদ্বেগজনক কথা বলা হয়। ভারতীয় অভিনেতা চিরঞ্জিত বাবুর ‘অপেক্ষা করুন অদূরভবিষ্যতেই সব দেখতে পাবেন’ উক্তিটি আমাদের জন্যে আরও উদ্বেগজনক। এই অবস্থায় বলতেই হয়, এমন মানসিকতা যাদের, তাদের সাহায্য, তাদের চুক্তি, সহযোগিতা সব কিছুর সুদূর প্রসারী লক্ষ্য হতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিষয়।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা সমস্যা:
জাতীয় ঐক্য ও সংহতি একটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। জাতির মধ্যে এই ঐক্য-সংহতি আসে জাতির বা রাষ্ট্রের উৎস, উদ্দেশ্য ও আদর্শের ঐক্য চেতনা থেকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, অতি গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়েই আমাদের অজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি। সাতচল্লিশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলে যে দর্শন কাজ করেছে, সেই দর্শনই আজকের স্বাধীন-সাবভৌম বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য চেতনার ভিত্তি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দাুন করে, তাতেও ধারাহিকতা অক্ষুন্ন রেখে স্বাতন্ত্র্যচেতনার ভিত্তিকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবও পাকিস্তানের জেল থেকে দেশে ফেরার পর এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বাংলাদেশকে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বলে অভিহিত করেন। পরে সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা সংযোজিত হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্য করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচয় বিশ্ববাসির সামনে তুলে ধরেন। আজও বাংলাদেশ ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্য। ইসলামকে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য চেতনার ভিত্তি থেকে বাদ দিলে এর বিকল্প হিসাবে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র চেতনা রক্ষার ভিত্তি কি হতে পারে, এ সম্পর্কে কারো যৌক্তিক কোনো বক্তব্য নেই। আসলে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য চেতনার ভিত্তি থেকে ইসলামকে সরিয়ে দিলে আমরা আমাদের পরিচয় ও স্বাধীন রাষ্ট্র সত্বার স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে নানা বিভ্রান্তিতে ডুবে যাব এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এই অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। টমাস জেফারসন বলেছেন, ‘কোনো জাতিই যুগপৎ’ অজ্ঞ ও স্বাধীন ছিল না এবং তা থাকতেও পারে না (If a nation expects to be ignorant and free, it expects what never was and never will be)’ টমাস জেফারসন একটা পরম সত্য এখানে তুলে ধরেছেন। অজ্ঞতাকে পাপ বলা হয় এই জন্যই। অজ্ঞ নিজকেই চেনে না, রাষ্ট্রকে চিনবে কি করে? এই অজ্ঞতা দোষে দুষ্ট আমাদের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী যে ডালে তাদের আশ্রয় সে ডালেরই গোড়া কাটছেন। এদের কারণেই জাতীয় ঐক্য সংহতি গড়ে উঠছে না। তাদের অজ্ঞতা জাতির অস্তিত্বকেই কুঠারাঘাত করছে। কেউ কেউ বলেন, তারা অজ্ঞ নয়, বিজ্ঞ। সেটা হলে তারা আরও বিপজ্জনক। সজ্ঞানভাবে রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য চেতনাকে অস্বীকার, রাষ্ট্রীয় নীতি-কার্যক্রমে মুসলিম পরিচয়ের প্রতি বৈরীতাকে ষড়যন্ত্রের অংশ বলাই যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশের নিরাপত্তার এটাই মৌলিক সমস্যা।
নিরাপত্তা সম্পর্কিত দুর্বলতা:
একজন বিখ্যাত মণিষী বলেছেন, ‘স্বাধীনতা ভঙ্গুর তাই তা রক্ষা করা প্রয়োজন (Freedom is fragile and must be Protected)। আর টমাস জেফারসন বলেছেন, ‘স্বাধীনতার মূল্য হলো অনন্তকাল সতর্কতা (The Price of freedom is eternal vigilance)। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার যে দাবী সার্বক্ষণিক সতর্কতা, সেটা এমনকি দেশের ভেতরের অনেকেও পারছি না। আমাদের এই দুর্বলতাই স্বাধীনতাকে ভঙ্গুরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। আমাদের বিভ্রান্তি ও অজ্ঞতা এতটাই যে ‘Defence of a Country without a defence force’ তত্ত্ব সামনে এনে আমরা অনেকে সেনাবাহিনী রাখাকে গরীবের ঘোড়া রোগ ধরনের কাজ বলে থাকেন। চারদিকের সব প্রতিবেশী দেশেই সেনাবাহিনী থাকবে আমাদের থাকবে না কিংবা নামমাত্র থাকবে, এটা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। ঐ কথাগুলো আজ যারা বলছে, তারা আমাদের ইতিহাস ও আজকের পৃথিবী কোনোটা সম্পর্কেই কোনো জ্ঞান রাখেন না। এদের কারণেই আমাদের ১৫ কোটি মানুষের সেনাবাহিনী উপযুক্ত সংখ্যায় এবং উপযুক্ত উপায়-উপকরণে গড়ে উঠতে পারছে না। অথচ একটা স্বাধীন দেশের জন্যে তার স্বাধীনতা রক্ষার উপযুক্ত শক্তি অর্জন অপরিহার্য। একজন মনিষী (Pericles) বলেছেন, ‘স্বাধীনতা কেবল তাদেরই সম্পত্তি, যারা এটাকে রক্ষা করার সাহস ও শক্তি রাখে।’ আরও স্পষ্ট ভাষায় Patric Henry বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত শক্তিছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। সেই শক্তিকে বিসর্জন দিলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য (Unfortunately nothing will preserve, but down right force. whenever you give up that force, you are ruined.)। সন্দেহ নেই এই শক্তি অর্জন না করা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ।
স্বাধীনতা ও ধর্ম:
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সংবিধানে মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয় সংশ্লিষ্ট রাখার বিরুদ্ধে বলতে গেলে ক্রুসেড শুরু করা হয়েছে। আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস সংবিধান থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দেয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে কিছু মানুষ। এমনকি তারা পাঠ্য পুস্তকে ইসলামের নামগন্ধ বরদাশত্ করতে পারছে না। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তার সাথে ধর্ম-পরিচয়ের বিষয়টি একেবারেই অচ্ছেদ্য। রজার টনি (Roger Tawny) একটা সুন্দর কথা বলেছেন, ‘আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার উপস্থিতি যে কোন ব্যক্তিকে বিশ্বের সকল শক্তির বিরুদ্ধে একাই দাঁড়াতে সাহস যোগায়।’ আর মাকিন সিনেটর Chaplain Richard Holverson বলেছেন, ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস অন্তর্হিত হলে জাতির স্বাধীনতা নিরাপদ হতে পারে না (the liberation of a nation cannot be secure when belief in God is abandoned) এই কথাগুলো বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি সত্য। কারণ যে দ্বিজাতিতত্ত্ব দর্শনের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছে, সে দর্শন ধর্মভিত্তিক এবং তা বাংলাদেশের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চেতনার রক্ষাকবচ। এই রক্ষাকবচের যদি বিলয় ঘটনো হয়, তাহলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র সীমানা রক্ষার ভিত্তিই অবশিষ্ট থাকবে না। আমাদের স্বাধীনতার বৈরী একটি লবী এটা জানে বলেই রাষ্ট্রের সাথে ধর্ম পরিচয়কে সংশ্লিষ্ট করার বিরোধিতার নামে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রসত্তার বিলয় ঘটাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তার জন্যে রাষ্ট্র ও সংবিধানের সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম পরিচয় তাই অপরিহার্য।
নিরাপত্তার প্রশ্ন আপোষযোগ্য নয়:
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রশ্নটি আপোষযোগ্য নয়। কোনো কিছুর সাথে এর ‘দেয়া-নেয়া’ চলতে পারে না। প্যাট্রিক হেনরী বলেছেন, ‘জনগণের স্বাধীনতাকে গভীর আন্তরিকতার সাথে রক্ষা করুন। এই দুর্মূল্য মানিক্যের দিকে অগ্রসরমান যে কারো উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখুন (guard with jealous attention the Public liberty, suspect everyone who approaches that jewel)।’ কিন্তু আমরা এটা কি করছি? আমাদের রাষ্ট্রিক ও জাতীয় পরিচয় নিয়ে সৃষ্ট নানা প্রশ্ন ও বিকৃত নানা তথ্য দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে কলুষিত করছে, মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তির পরিসর ধীরে ধীরে বাড়ছে। সেই ‘৯১-এর দিকে তাদের যে রাখ-ঢাক ছিল, যে ভয়-দ্বিধা ছিল তা এখন নেই। বিপজ্জনক কথাগুলো মানুষের গা সহা হয়ে যাচ্ছে। বিভ্রান্তির দিকটা মানুষের মধ্যে গভীর হয়ে উঠছে। বিষয়টা উদ্বেগজনক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিচারক জাস্টিস লার্নেড হ্যান্ড এক মন্তব্যে বলেছেন, ‘স্বাধীনতার অবস্থান মানুষের অন্তরে। সেখান থেকে তা উঠে গেলে কোনো সংবিধান, কোনো আইন, কোনো আদালতই তাকে আর ধরে রাখতে পারে না।’ আমাদের রাষ্ট্র পরিচয়, এমনকি জাতীয় নেতাদের নিয়ে অপপ্রচার ও ভ্রান্তি ছড়ানোর লক্ষ্য এটাই। দেরীতে হলেও এ বিষয়ের প্রতি আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে আজ গুরুত্ব দিতে হবে।
উপসংহারে আমি একজন পশ্চিমা মণিষীর কথা দিয়ে আমার আজকের এ লেখার ইতি টানতে চাই। মণিষী জন ফিল্পট কুরন বলেছেন, ‘যে শর্তে ঈশ্বর মানুষকে স্বাধীনতা দান করেছেন, তাহলো স্বাধীনতাকে সদা সতর্ক পাহারায় রাখা। এই শর্ত যদি সে ভঙ্গ করে তাহলে তার অপরাধের দন্ড হবে দাসত্ব (The condition upon which God hath given liberty to man is eternal vigilance, which condition if he breaks, servitude is at once the consequence of his crime, and the punishment of his guilt)।
আমরা এ পরিণতি চাই না। আল্লাহ এ পরিণতি থেকে আমাদের রক্ষা করু

 

http://www.dailysangram.com/post/277213-