২৭ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১২:০৪

সারাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানতের পরিমাণ ১৩ হাজার কোটি টাকা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : সর্বস্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবা দিতে ২০১৪ সালে দেশে চালু হয়েছিল এজেন্ট ব্যাংকিং। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালু হয়। আর বাংলাদেশে সেবাটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি। ব্যাংক এশিয়া প্রথম এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দেওয়া শুরু করে। বর্তমানে ২৪টি ব্যাংক এই সেবা দিচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আমানত বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার ৪০ কোটি টাকা। যা মার্চে ছিল ৮ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। এই সময়ে আমানত বেড়েছে ৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে ১ হাজার ৮৬ কোটি টাকা, মার্চে যা ছিল ৬৭৩ কোটি টাকা। বেড়েছে ৪১৩ কোটি টাকা। সারা দেশের প্রায় ১৫ হাজার আউটলেটে চলছে ব্যাংকিং সেবা। করোনার মধ্যে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই সেবার।

জানা গেছে, বিদায়ী ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন এই ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ৮২ লাখ গ্রাহক হিসাব খুলেছেন। ডিসেম্বর শেষে এই সংখ্যা এক কোটির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে জানান ব্যাংক কর্মকর্তারা। করোনাভাইরাসের প্রকোপের শুরুর দিকে মার্চ-এপ্রিলে ব্যাংকের শাখা বন্ধ থাকার সময় সব এজেন্ট খোলা ছিল। এতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর মানুষের আস্থা বেড়েছে। বদৌলতে করোনাকালে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে এজেন্টের সংখ্যা বেড়ে হয় ১০ হাজার ১৬৩, যা মার্চে ছিল ৮ হাজার ২৬০। করোনার মধ্যে ৬ মাসে এজেন্ট বেড়েছে ১ হাজার ৯০৩। সেপ্টেম্বর শেষে আউটলেট বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ১৬টি, মার্চে যা ছিল ১১ হাজার ৮৭৫টি। ৬ মাসে আউটলেট বেড়েছে ২ হাজার ১৪১টি। আর সেপ্টেম্বর শেষে গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ লাখ ২১ হাজার ৮৯৩ জনে, যা মার্চে ছিল ৬৪ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫১ জন। করোনার ৬ মাসে গ্রাহক বেড়েছে ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৪৪২।

তথ্য বলছে, মার্চ-সেপ্টেম্বর সময়ে নতুন যে হিসাব খোলা হয়েছে, তার মধ্যে নারীর হিসাবের সংখ্যা প্রায় আট লাখ। ফলে গত সেপ্টেম্বরে নারীদের হিসাবের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৯ হাজার, মার্চে যা ছিল ২৯ লাখ ৫৬ হাজার। আবার মোট ৮২ লাখ হিসাবের মধ্যে গ্রামীণ হিসাবই ৭১ লাখ ১২ হাজার। মার্চে এই সংখ্যা ছিল ৫৫ লাখ ৮৩ হাজার। অর্থাৎ ৬ মাসে গ্রামের মানুষদের হিসাব বেড়েছে ১৫ লাখ ২৯ হাজার।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র সাত বছরেই এজেন্ট ব্যাংকের গ্রাহক বেড়ে এক কোটির কাছাকাছি হয়েছে। ব্যাংকগুলোর এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ইউনিয়ন পর্যায়েও চালু হয়েছে। আমানত রাখা, ঋণ বিতরণ ও প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি স্কুল ব্যাংকিং চালু করেছে এজেন্টরা। শুধু তাই নয়, সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতাও বিতরণ করছে এখন এজেন্টরা। ব্যাংকটির গ্রাম-গঞ্জের গ্রাহকরা সুপ্রশিক্ষিত এজেন্ট ব্যাংকারের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স অল্প সময়ের মধ্যে হাতে পাচ্ছেন। বিদ্যুৎ বিল দিয়ে যাচ্ছেন সবাই। হাজার হাজার গ্রাহক প্রতি মাসে এসে ডিপিএসের টাকা জমা দিচ্ছেন। বিভিন্ন ধরনের মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়ী হিসেবে দশ লাখ, ২০ লাখ বা তারও বেশি টাকা জমা করছেন অনেকে। গ্রাহকরা তাদের বিমার মেয়াদ পূরণ হলে টাকা যেমন তুলতে পারছেন, প্রিমিয়ামের টাকাও জমা দিচ্ছেন। অবসর নেওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এজেন্ট শাখা থেকে তুলছেন পেনশনের টাকা। শিক্ষকরা প্রতি মাসে তুলছেন বেতন। সুযোগ পেলেই স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে এসে টাকা জমা করছে। কৃষক থেকে শুরু করে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরাও এজেন্ট শাখায় হিসাব খুলছেন।

ব্যাংকাররা বলেন, কেউ বাসার পাশে সেবা পাওয়ায়, আবার কেউ সঞ্চয়ের জন্য এজেন্ট ব্যাংকিং হিসাব খুলেছেন। করোনাকালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক ও আমানতের পাশাপাশি ঋণ বিতরণ আর প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স আনার পরিমাণও বেড়েছে।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গত সেপ্টেম্বরে আমানত বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার ৪০ কোটি টাকা, মার্চে যা ছিল ৮ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। এই সময়ে আমানত বেড়েছে ৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে ১ হাজার ৮৬ কোটি টাকা, মার্চে যা ছিল ৬৭৩ কোটি টাকা। ঋণ বেড়েছে ৪১৩ কোটি টাকা। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে যেখানে এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, সেখানে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা বেড়ে হয়েছে ৩৯ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিকের চেয়ে পরের তিন মাসে প্রবাসী আয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বড় ভূমিকা রাখছে এজেন্ট ব্যাংক। শুধু ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে। তথ্য বলছে, করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালে ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ২৬১টি নতুন এজেন্ট আউটলেট চালু করেছে। এ সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নতুন হিসাব খোলা হয়েছে ৮ লাখ ৪২ হাজার। আমানত বেড়েছে ৩ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৪৮ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। এর মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে ২২ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, মার্চ-সেপ্টেম্বরে নতুন যে হিসাব খোলা হয়েছে, তার মধ্যে নারীদের হিসাবের সংখ্যা ছিল প্রায় আট লাখ। এতে নারী গ্রাহকের হিসাবের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৯ হাজার, মার্চে যা ছিল ২৯ লাখ ৫৬ হাজার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে যেখানে এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, সেখানে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা বেড়ে হয়েছে ৩৯ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।

এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে এজেন্টদের ৮৬ আর আউটলেটের ৮৮ শতাংশই একেবারে গ্রাম পর্যায়ে। আবার অ্যাকাউন্টের দিক থেকে শহর এলাকায় যেখানে ৯ লাখ ৮০ জাজার ৫১১টি অ্যাকাউন্ট সেখানে গ্রাম এলাকায় হয়েছে ৬৩ লাখ ৭৬হাজার ৬৮৬টি অ্যাকাউন্ট। আর অ্যাকাউন্টের হিসেবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের শীর্ষে থাকা পাঁচটি ব্যাংকের নাম উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলো হলো ডাচ বাংলা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইসলামী ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। এ মুহূর্তে গ্রাম এলাকায় সবচেয়ে বেশি এজেন্ট আছে ব্যাংক এশিয়ার যার সংখ্যা ৩৩২৫।

ব্যাংক কর্মকর্তরা বলছেন, এজেন্ট ব্যাংকিং মডেলটা হলো- একজন গ্রাহক এজেন্ট পয়েন্টে যা করবে সেটা রিয়েল টাইম ব্যাংকিংই করলো। অর্থাৎ মূল শাখায় এসে তিনি যে সার্ভিস পেতেন সেটাই ওখানে পাচ্ছেন। শুধু অতিরিক্ত নিরাপত্তার স্বার্থে এজেন্ট পয়েন্টে কাজ হয় বায়োমেট্রিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে, অর্থাৎ প্রত্যেকে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে কাজ করতে হয়। ব্যাংকের মূল অ্যাকাউন্ট খোলার সময় সবাইকেই এই ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হয়। তারা বলেন, একজন ব্যক্তি একটি এজেন্ট পয়েন্টে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন বা তার অন্য ব্রাঞ্চে অ্যাকাউন্ট থাকলে তার বিপরীতে সব সেবা নিতে পারবেন। টাকা তোলার ব্যবস্থা, টাকা জমা দেয়া, রেমিটেন্স এমনকি অন্য ব্যাংকের হিসেবেও টাকা পাঠানো বা সেখান থেকে নিজের অন্য ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে টাকা আনার কাজও করা যাবে। একজন গ্রাহক টাকা জমা দেবে এজেন্টের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ব্যাংকের কম্পিউটার জেনারেটেড রিসিট পাবেন ও তার ফোনে টাকা জমা হয়ে যাওয়ার এসএমএস আসবে ব্যাংক থেকে। লেনদেনটির সাথে সাথে ব্যাংকের মূল সার্ভারে গ্রাহকের তথ্য হালনাগাদ হয়ে যাবে।

এজেন্ট কারা হতে পারবেন যে বিষয়েও একটি দিক নির্দেশনা রয়েছে। সেগুলো হলো- মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি অব বাংলাদেশ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এনজিও ও অন্যান্য নিবন্ধিত এনজিও, কো-অপারেটিভ সোসাইটি (সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ অধীনে), ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিবন্ধিত ডাকঘর, কুরিয়ার এবং মেইলিং সার্ভিস কোম্পানি, কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর অধীনে নিবন্ধিত কোম্পানি, মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর এজেন্ট, গ্রামীণ ও শহরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান অফিস, ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র, আইটি ভিত্তিক আর্থিক সেবা, বীমা কোম্পানির এজেন্ট, ফার্মেসির মালিক, মুদি দোকান এবং পেট্রল পাম্প/গ্যাস স্টেশন পরিচালনা করতে সক্ষম শিক্ষিত ব্যক্তি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সুপারিশকৃত বা অনুমোদিত যেকোনো প্রতিষ্ঠান। তবে এক ব্যাংকের এজেন্ট অন্য ব্যাংকের এজেন্ট হতে পারবে না। এজেন্টকে ব্যাংকের দেয়া ইলেকট্রনিক ডিভাইস রক্ষণাবেক্ষণ ও সব লেনদেনের রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে। ব্যাংককে অডিটে সহযোগিতা করতে হবে। ঋণ বিতরণ ও কিস্তি আদায়ের দায়িত্বও এজেন্টের। কোনোভাবেই এজেন্ট কোনো বাড়তি চার্জ আরোপ করতে পারবে না।

https://dailysangram.com/post/441844