২৭ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১২:০৩

স্বদেশ ভাবনা

দেশে দারিদ্র্যের হার কত?

গত প্রায় এক বছরে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মানুষের আয় কমে গেছে, যা দারিদ্র্যের হারকে প্রভাবিত করেছে।

এ সময়ে একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত জরিপে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬-এর চূড়ান্ত রিপোর্টে (মে ২০১৯) দাঁড়িয়েছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশে।

২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হায়েসের প্রাথমিক রিপোর্টে দারিদ্র্যের হার দেখানো হয়েছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। সানেমের সদ্য প্রকাশিত জরিপ এবং ইতঃপূর্বে প্রকাশিত অন্যান্য বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখানো উচ্চ দারিদ্র্য হারের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ করা হয়েছে বলে জানা নেই।

গত ২৩ জানুয়ারি রাজধানীতে সানেম আয়োজিত ‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সদ্য সমাপ্ত ২০২০ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে দেশজুড়ে খানা পর্যায়ে পরিচালিত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান।

জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে দারিদ্র্যের হার ও মাত্রা দুটোই বেড়েছে। এতে মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন, ঋণ নিয়েছেন এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন।

করোনা মহামারির প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। তবে জরিপে উঠে আসা সার্বিক দারিদ্র্য হারের তুলনায় রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেশি। রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল যথাক্রমে ৫৭ দশমিক ৫, ৫৫ দশমিক ৫ এবং ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

উল্লেখ্য, বিবিএস পরিচালিত ২০১৬ সালের হায়েসের চূড়ান্ত রিপোর্টেও এ তিনটি বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। রংপুর, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল যথাক্রমে ৪৭ দশমিক ২, ৩২ দশমিক ৮ এবং ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ।

সানেমের জরিপ প্রকাশিত হওয়ার আগে গত বছর একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে আসে দেশে উচ্চ দারিদ্র্য হারের তথ্য। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জুন মাসের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে দারিদ্র্য বেড়ে ৪৩ শতাংশ হয়েছে।

গত জুনে প্রকাশিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, করোনার কারণে বেড়েছে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা, আয় কমেছে মানুষের। ফলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

গত বছর আগস্ট মাসে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও অস্ট্রেলিয়ার ওয়াল্টার এলিজা হল ইনস্টিটিউটের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির সংক্রমণ ঠেকাতে মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ছুটিতে ৯৬ শতাংশ পরিবারের গড় মাসিক উপার্জন হ্রাস পায়; ৯১ শতাংশ নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল মনে করে এবং ৪৭ শতাংশ পরিবারের আয় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।

পরিবারগুলোর ৭০ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ১৫ শতাংশ খাদ্য সংকটে ভোগে বা কোনো একবেলা না খেয়ে থাকে। আর বিবিএসের গত সেপ্টেম্বর মাসের এক জরিপ অনুযায়ী, করোনা মহামারির প্রভাবে মানুষের মাসিক আয় ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। মহামারিতে আয় কমে যাওয়ায় খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমেছে ৫২ শতাংশের মতো পরিবারের।

হায়েস-২০১০ অনুযায়ী, দেশে ২০০৫ সালের ৪০ শতাংশ দারিদ্র্য হার হ্রাস পেয়ে ২০১০ সালে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে। এতে প্রতিবছর দারিদ্র্য হার হ্রাস পায় ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। হায়েস-২০১৬ মোতাবেক ২০১০ সাল-পরবর্তী বছরগুলোয় প্রতিবছর দারিদ্র্য হার হ্রাস পায় ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে। দারিদ্র্য হার হ্রাসের শ্লথ গতি পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য হার বৃদ্ধি ঘটায়। যেসব কারণে ২০১০ সালের পর দারিদ্র্য হ্রাসের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে এবং করোনাকালে দারিদ্র্য হার বৃদ্ধি পায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-এক. কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হার হ্রাস।

সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষিখাতের ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হার পরবর্তী প্রায় এক দশকে গড়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে (অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা ২০১৮-১৯)। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানা নেই।

তবে ওই অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে করোনা মহামারি, ঘূর্ণিঝড় আম্পান এবং দীর্ঘ খরার কারণে কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার আরও হ্রাস পাওয়া বই বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি এবং দারিদ্র্য হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়া দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।

দুই. উন্নয়নের ‘ট্রিকল ডাউন’ বা চুইয়ে পড়া তত্ত্ব তেমন কাজে আসছে না। গত এক দশকে স্থূল দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) লক্ষণীয় প্রবৃদ্ধি ঘটলেও তা সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তেমন কাজে আসছে না। দেশে সম্পদ অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। দ্রুত ধনীদের শীর্ষ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ।

গত এক দশকে শুধু দারিদ্র্য হ্রাসের গতি মন্থর হয়নি, বেড়েছে দারিদ্র্য ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা। বিবিএসের মতে, ২০০০ সালে যেখানে দেশে দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে থাকা মানুষ ছিল ৩৫ শতাংশ, সেখানে ২০১৬ সালে তা বেড়ে ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। করোনাকালেও ধনী-গরিবের আয়বৈষম্য বেড়েছে বই কমেছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।

তিন. বেকারত্ব বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সার্বিক বেকারত্বের হার ২০১০ সালের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭ সালে ৪ দশমিক ৪ শতাংশে এবং শ্রমশক্তির শিরোমণি যুবকদের বেকারত্ব হার ২০১০ সালের ৬ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৭ সালে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়ায়। বেকারত্বের এ উচ্চহার অব্যাহত থাকে।

করোনা মহামারির সংক্রমণ রোধে গত বছর মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত সময়ে লকডাউনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে দেশে, বিশেষ করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বেকারত্বের হারে উল্লম্ফন ঘটে। গত ১ মে যুগান্তরের এক রিপোর্টে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে শুধু পরিবহণ খাতের ৫০ লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হন।

হোটেল, রেস্তোরাঁ, টুরিজমসহ সেবা খাতের বহু কর্মী বেকার হয়ে পড়ে। দ্য ডেইলি স্টারের গত ২৪ জানুয়ারির এক রিপোর্ট অনুযায়ী, করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে শুধু তৈরি পোশাক শিল্পে সাড়ে তিন লাখের বেশি কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। তা ছাড়া বৈশ্বিক করোনার কারণে বহুসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসে বেকারত্ব সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। বেকারত্বের উল্লম্ফনে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পায়। কারণ, অর্থনীতির সংজ্ঞা মোতাবেক বেকারত্ব ও দারিদ্র্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

চার. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে একটি স্বীকৃত পন্থা। এটি ঠিক, এ কর্মসূচির আওতায় ক্রমান্বয়ে কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটছে এবং অর্থ বরাদ্দ বাড়ছে। সমস্যা হলো, যে হারে ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে, সে হারে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না।

যেমন চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ০১ শতাংশ। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। তবে সমস্যা হলো বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যেভাবে বরাদ্দ বেড়েছে, ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে তার চেয়ে বেশি। চলতি অর্থবছরও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

এতে ভাতাভোগীদের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না এবং তারা ‘দারিদ্র্য চক্র’ থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। ফলে মন্থর হয়ে পড়ছে দারিদ্র্য কমার হার। করোনাকালে আয় হ্রাসের কারণে দারিদ্র্যসীমার সামান্য উপরে অবস্থানকারী অনেকে দারিদ্র্যের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে, যারা এ কর্মসূচির আওতায় আসেনি। ফলে বেড়ে যাচ্ছে দারিদ্র্যের হার।

সবশেষে যা বলতে চাই তা হলো, দেশে বর্তমান দারিদ্র্যের হার সম্পর্কে বিদ্যমান ধোঁয়াশা পরিষ্কার হওয়া দরকার। করোনাকালে প্রণীত চলতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দেশে দারিদ্র্যের হার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেননি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দেওয়া দারিদ্র্যের হারের বিরোধিতা করে সরকার থেকে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সানেমের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য যথার্থ হলে তা দেশের জন্য মোটেই সুখকর নয়।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/388046/