২৭ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১২:০০

ভোজ্যতেলের অগ্নিমূল্য

ইবনে নূরুল হুদা : আমাদের দেশের মত অনিশ্চিত বাজার পরিস্থিতি বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না। আজ এক রকম তো আগামীকালই অন্যরকম। করোনাকালীন সময়েও এই পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। চলমান সঙ্কটে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলেও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য। প্রতিনিয়ত আয়ের সাথে সঙ্গতিহীন হয়ে উঠছে আমাদের বাজার পরিস্থিতি। সরকার তা কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না বা করছে না। ফলে মূল্যস্ফীতি এখন রীতিমত লাগামহীন।

সে ধারাবাহিকতায় ভোজ্যতেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে সম্প্রতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে উৎপাদন কম হওয়ায় বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে তেলের বাজার। সেই প্রভাবের ঢেউ আছড়ে পড়েছে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারেও। কিন্তু ঘাটতির কারণে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে যে ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে আমাদের পরিস্থিতি তারচেয়েও অধিক ভয়াবহ। কারণ, বিষয়টিকে অজুহাত বানিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছামত ও অযৌক্তিকভাবে তেলের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। যা ইতোমধ্যেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

গত চার মাসে বাংলাদেশের বাজারে গড়ে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে ৫৬.২৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ি দেশে তেলের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তেল আমদানিকারকরা। তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে লিটার প্রতি দাম ১৫ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করাসহ ভোজ্য তেলে তিন স্তরের ভ্যাটের পরিবর্তে এক স্তরের ভ্যাট নির্ধারণের আবেদন করেছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বাণিজ্যমন্ত্রণালয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশনা পাঠিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক সিদ্ধান্তের খবর পাওয়া যায়নি। ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি।

ফলে ভোজ্যতেলের বাজার এখন আকাশচুম্বী। রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার পর্যালোচনায় খোলা সয়াবিন তেল ১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়। বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৪০ টাকায়। এক কেজি লুজ পামঅয়েল ১০৫ টাকা এবং সুপার পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসেও প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়। অর্থাৎ গত চার মাসে প্রতি কেজি সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ টাকা। গত সেপ্টেম্বরে খোলা সুপার পাম তেলে বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকায়। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকায়। সেই হিসাবে গত চার মাসে সুপার পামের দাম বেড়েছে ৪৫ টাকা। আর গত চার মাসে সব ধরনের তেলের দাম বেড়েছে ৫৬ দশিমক ২৫ শতাংশ।

আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, বর্তমান আমদানিমূল্যের সাথে সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স, পরিশোধন ও বিপণন খরচ যোগ করলে এখন প্রতি লিটার সয়াবিন বোতলজাতকরণ পর্যন্ত খরচ পড়ে ১৩২ টাকা। বাজারে এখন যে দামে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে, গত সপ্তাহের আমদানিমূল্য ধরে বিক্রি করলে খুচরা মূল্য আরও বেশি হওয়া উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারের এ ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোয় ভোজ্য তেলের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা পরিশোধনকারীদের। এজন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ঊর্ধ্বমুখী ধারা বিবেচনা করে সম্প্রতি প্রতি লিটার ভোজ্য তেলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণসহ তিন স্তরের ভ্যাট থেকে এক স্তরে নামিয়ে আনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু ওই চিঠির পর আন্তর্জাতিক বাজারে আরও কয়েক দফা বেড়েছে পণ্যটির দাম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী চাহিদার তুলনায় পণ্যটির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম হু হু করে বাড়ছে। ৭শ ডলারের সোয়াবিন তেল এখন ১ হাজার ২শ ২০ ডলার। আর গত কয়েক মাসে তেলের দাম ৫শ ডলার বেড়েছে, প্রতি মেট্রিক টনে ৪০ হাজার, প্রতি কেজিতে ৪০ টাকা। সে হিসেবে আমাদের বাজারে দাম বৃদ্ধি পায়নি বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করলেও বাস্তবতার সাথে তার কোন সামঞ্জস্যতা নেই। তবে পরিস্থিতির যতদ্রুত অবনতি হচ্ছে তাতে আগামী দিনে ভোজ্যতেলের মূল্যের আরও বড় ধরনের অবনতি হতে পারে।

এ বিষয়ে সরকারের উদাসীনতা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীকেও দায়ি করছেন অনেকেই। কারণ, চলমান ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট খাতে যেখানে বড় ধরনের ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন, সেখানে সরকারি ভ্যাট ও ট্যাক্সের চাপে ব্যবসায়িরা অনেকটাই বেসামাল। আর বিষয়টিকে অজুহাত বানিয়ে তারা ইচ্ছামত ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। মূলত, করোনার নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তেলের সরবরাহ কমেছে। এছাড়া তিন পর্যায়ে ভ্যাট-ট্যাক্স মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আমদানিতে ২০ শতাংশ, উৎপাদনে ১৫ শতাংশ এবং বিক্রয় পর্যায়ে ৫ শতাংশ করে মোট ৪০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। আমদানিকারকরা তা এক স্তরে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন সুখবর নেই।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশেও (ক্যাব) বলছে, ভোজ্যতেলের মতো একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে তিন স্তরে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট যৌক্তিক নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে করকাঠামো পুনর্বিবেচনা করা দরকার। তাহলে মূল্যস্ফীতির লাগাম কিছুটা হলেও টেনে ধরা সম্ভব। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কোন তৎপরতা নেই।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এফএওর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ি, গত দুই মাসে ব্যাপকভাবে বেড়েছে ভোজ্য তেলের দাম। তিন কারণে বিশ্ববাজারে বাড়ছে ভোজ্য তেলের দাম। সরবরাহ ঘাটতি, রপ্তানি কর বৃদ্ধি ও চীনের বিপুল ক্রয়ের কারণে বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েই চলেছে। সয়াবিনের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ আর্জেন্টিনায় সরকারের সঙ্গে কৃষকদের দ্বন্দ্বে ধর্মঘট চলছে। এই ধর্মঘট ফেব্রুয়ারি পর্যন্তও চলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সয়াবিন রপ্তানিতে কর বাড়িয়ে ৩৩ শতাংশ করেছে আর্জেন্টিনা। ফলে বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ২০১৪ সালের জুলাইয়ের পর সর্বোচ্চ মূল্য।

এফএও জানিয়েছে, পাম তেলের বড় রপ্তানিকারক দেশগুলো থেকে সরবরাহ কমেছে। বিশেষ করে সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া বিপুল রপ্তানি শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে। ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানিতে শুল্ক প্রতি টন ৫৫ ডলার থেকে বাড়িয়ে মান ভেদে ২৫৫ ডলার পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিকূল আবহাওয়া ও শ্রম সংকটের কারণে পাম তেল উৎপাদন কমিয়েছে মালয়েশিয়া। এমনকি ইন্দোনেশিয়ার পথ ধরে এই দেশটি এ বছর পাম তেল রপ্তানিতে কর বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছে মালয়েশিয়ার ‘পাম অয়েল বোর্ড’। দেশটির পাম তেল রপ্তানি কর ৬.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ হবে বলে আগাম ধারণা দেয়া হয়েছে। এতে প্রতি টন রপ্তানিতে শুল্ক পড়বে ৬৮ ডলার। ফলে বিশ্ববাজারে আরো বাড়তে পারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম।

আমাদের দেশে বছরে প্রায় ২৮ লাখ টন পরিশোধিত ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া দেশে প্রতি বছর আরও প্রায় দুই লাখ টন অভোজ্য তেল আমদানি করা হয়। ২৮ লাখ টন ভোজ্য তেলের মধ্যে ৯০ শতাংশই আমদানি হয়। চাহিদার মোট ভোজ্য তেলের মধ্যে সয়াবিন তেলের অংশ হচ্ছে ৪০ শতাংশের মতো। পাম তেলের অংশ হচ্ছে ৫২ শতাংশের মতো এবং বাকিটা সরিষা ও অন্যান্য তেল।

ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, পাইকারি ও খুচরা বাজারে ভোজ্য তেলের দাম যেভাবে বেড়েছে তা ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় হওয়ায় দেশের বাজারেও ভোজ্য তেলের দাম বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারেই ভোজ্য তেলের সরবরাহ কম। শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে বলে মনে করেন তারা। এ বিষয়ে কোন নজর নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতির কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারেও তার প্রভাব পড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১২৫-১৩৫ টাকা কেজিতে। গত সপ্তাহে পাইকারিতে ছিল ৪ হাজার ২০০ টাকা মণ বা ১১২ টাকা কেজি। দেশে গত আগস্ট মাসে ৫ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ছিল ৫০৫ থেকে ৫১৫ টাকা। বর্তমানে তা ৬১৫ থেকে ৬২৫ টাকা। অর্থাৎ গত ৫ মাসে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ২২ টাকা বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। সয়াবিনের মতো পাম তেলের দামও বেড়েছে। পাইকারিতে পাম সুপার বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৯০০ টাকা মণ, যা ২ সপ্তাহ আগেও ১০০ টাকা কম ছিল। খুচরায় পাম সুপার বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকা লিটার।

মূলত, অন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ কম থাকায় আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারেও মাত্রাতিরিক্তভাবে তেলের দাম বেড়েছে। কিন্তু কমেছে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা। যা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এমতাবস্থায় ভোজ্যতেলের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সেখানে তেল আমদানিতে ভর্তুকী দেয়া জরুরি সেখানে আমদানিকারকদের ওপর উল্টো ভ্যাট ও করের বোঝা সার্বিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলেছে।

এমতাবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সকলপ্রকার ভোজ্যতেল আমদানি ভ্যাট ও করমুক্ত করে ভর্তুকী দেয়ার পরামর্শ এসেছে বাজার বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে। একই সাথে ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে সরিষার তেলের ব্যবহারকে উৎসাহিতকরণ ও সরিষাচাষিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এমনকি দেশেই সয়াবিনের চাষের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শও এসেছে সংশ্লিষ্টদের পক্ষে থেকে। চলমান বাজার পরিস্থিতিতে আমদানি নির্ভরতা কমানো না গেলে এবং আমদানিতে ভ্যাট ও ট্যাক্সের বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করা না হলে ভোজ্যতেলের বাজার সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা সম্ভব হবে না। ফলে জনদুর্ভোগ অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠছে। জনগণ সংশ্লিষ্টদের কাছে এ বিষয়ে দায়িত্বশীল ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত আশা করে।

https://dailysangram.com/post/441868