২৫ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ৯:২৪

কড়াইল বস্তি কেন পুড়ছে বারবার

২০১৬ সালের ১৪ মার্চ রাতে রাজধানীর কড়াইল বস্তির বেলতলা অংশে আগুন লাগে। এতে অর্ধশতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়। এরপর আগুনের কারণ নির্ণয় ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পক্ষে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিবেদন জমা দিতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ১৫ কর্ম দিবস। বছর পার হলেও সে ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। আগুনের কারণও জানা যায়নি। তারপর আরও চারবার আগুনে পুড়েছে কড়াইল বস্তি। ২০১৩ সালের মে থেকে চলতি বছরের ১৬ মার্চ পর্যন্ত প্রায় চার বছরে ১১ বার আগুন লাগার তথ্য মিলেছে। কিন্তু কোনোটিতেই আগুনের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৯৫ একর জায়গার মালিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডসহ (বিটিসিএল) একাধিক সংস্থা। সেখানে বস্তি গড়ে তুলে দেড়-দুই লাখ লোক বহুকাল ধরে বসবাস করে আসছেন। ঘর রয়েছে অন্তত

১২ হাজার। কিন্তু আতঙ্ক সঙ্গি করেই তারা প্রতি রাতে ঘুমাতে যান। এ যেন তাদের প্রতিকারহীন নিয়তি, বারবার আগুন লাগবে; পুড়ে ছাই হবে সাজানো সংসার। আবার তারা ছাইয়ের ওপর নতুন সংসার সাজানোর কষ্টসাধ্য চেষ্টা করবেন। সর্বস্ব হারানো মানুষগুলো জানতেও পারেন না কেন, কী কারণে বারবার তাদের আগুনে পুড়তে হয়। তাদের প্রশ্ন- সরকারি এ জায়গা থেকে তাদের উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে কী কোনো পক্ষ আগুন লাগিয়ে দেয়, নাকি তারা 'নিছক' দুর্ঘটনার শিকার হন। প্রতিটি আগুনের ঘটনার পরই ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ তোলেন, তাদের উচ্ছেদ করতে আগুন দেওয়া হয়।

কড়াইলের বেলাতলা রোডে বউবাজার সংলগ্ন বস্তির বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস খান সমকালকে বলেন, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আগুনে তার ১০টিসহ ওই বস্তির অন্তত ৫০০ ঘর পুড়ে যায়। ঘটনার পর শুনেছিলেন একটি লেপ-তোশকের দোকান থেকে আগুন বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে আজও আগুনের প্রকৃত কারণ জানতে পারেননি।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা যায়, ওই বস্তিতে ৪ ডিসেম্বরের অগি্নকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিসের সে সময়ের উপ-পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা শওকত হাসানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। আজও সেই প্রতিবেদন জমা পড়েনি। ওই তদন্ত কমিটির প্রধান বর্তমানে উপপরিচালক (অ্যাম্বুলেন্স) হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সমকালকে বলেন, 'আমি কয়েকদিনের জন্য দায়িত্বে ছিলাম। ওই সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারিনি। এখন আমি সেখানে নেই। এখন যিনি আছেন; তিনিই বিষয়টি দেখবেন। কারণ তদন্ত কমিটির প্রধান কোনো ব্যক্তি নয়, পদ।' তবে ভিন্ন কথা বলেন বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) হিসেবে থাকা দেবাশীষ বর্ধন। তিনি বলেন, পদ থেকে সরে গেলেই তদন্ত কমিটির প্রধানের দায়িত্ব শেষ হয় না। যাকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়, তদন্ত তারই শেষ করার কথা। বারবার কড়াইল বস্তির আগুন সম্পর্কে দেবাশীষ বর্ধন বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার আগে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। তবে বস্তিতে আগুনের সম্ভাব্য কারণের অন্যতম হলো বস্তিবাসীর অসচেতনতা। এ ছাড়া আগুনের বহু কারণ রয়েছে। অবহেলাও রয়েছে। সেখানে বিদ্যুতের প্রচুর সংযোগ অবৈধভাবে টানা হয়েছে। সেই বিদ্যুতের তার আবার পুরোনো, জোড়াতালিও দেওয়া থাকে। চোরাই সংযোগে হিটার চালানো হয়।

ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউস সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ১৪ মার্চের আগুনের ঘটনায় উপসহকারী পরিচালক সালেহ উদ্দিনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও এক বছরেও তা জমা দেয়নি কমিটি। এ বিষয়ে সালেহ উদ্দিন বলেন, প্রতিবেদন জমা দিয়েছি কি-না খেয়াল নেই। আমি প্রশিক্ষণে আছি। অফিসে যাওয়ার পর বিষয়টি জানাতে পারব।' তবে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (ওয়্যারহাউস) শামীম আহসান চৌধুরী বলেন, ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি এখনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি। কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চার বছরে ১১টি আগুনের ঘটনার মধ্যে তিনটি ছিল বড়। সর্বশেষ গত ১৫ মার্চ রাত আড়াইটার দিকে কড়াইল বস্তির বউবাজার অংশে আগুন লাগে। বেশি বাতাস থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একতলা ও দ্বিতলবিশিষ্ট টিনের ঘরগুলো যায় পুড়ে। বাজারের দোকানগুলোও ভস্মীভূত হয়। আগুন নেভানোর পর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়, দোকানসহ চার শতাধিক ঘর পুড়েছে। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপে চার হাজারের বেশি ঘর পোড়ার তথ্য মিলেছে। এ ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস গঠিত তিন সদস্যের কমিটি তদন্ত শুরু করেছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, গুলশান-বনানীর বুকের মধ্যে সরকারি জায়গায় গড়ে ওঠা কড়াইল বস্তিতে রিকশা, গাড়িচালক, পোশাক শ্রমিক, দিনমজুরসহ রাজধানীর নিম্ন আয়ের বহু মানুষের বসবাস। এই বস্তি ঘিরে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও পুরনো। অবৈধভাবে ঘর তুলে ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একাধিক চক্র। অবৈধ এ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন মমিন, আলমগীর, মঞ্জুরুল হক, শিপন, শহীদসহ আরও কয়েকজন।

http://bangla.samakal.net/2017/03/25/279695#sthash.BrfWn0OA.dpuf