২৬ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৫৮

খরচে কাটছাঁট, টিকা দেওয়া নিয়ে সংকট

হঠাৎ করেই যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপরে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন দেশে করোনাভাইরাসের টিকা এসে পৌঁছাল, তার আগ মুহূর্তেই এই টিকা সারা দেশের অভিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেওয়ার ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৯টি খাতের অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছে অর্থ বিভাগ। ফলে টিকা এখন কিভাবে দেওয়া শুরু করবে, কিভাবে ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাবে, কিভাবে ডাটাবেইস তৈরি করবে কিংবা কিভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে—এমন বিষয়ে উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। এমনকি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে টিকা দেওয়ার কাজে যে ৪২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মীকে প্রস্তুত করা হয়েছে, তাঁদের আপ্যায়নের জন্যও কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, প্রচার বা বিজ্ঞাপনের জন্য দেওয়া হয়নি এক পয়সাও।

বিষয়টি নিয়ে খোদ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজেট না দিলে কাজ চলবে কী করে? আমি কালই (আজ) অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলব।

তবে যেভাবেই হোক আমরা কাজ ব্যাহত হতে দেব না। কাজ যেভাবে পারি চালিয়ে যাব। টাকা হয়তো পরে পেলেও পাব।’

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখার সূত্র থেকে পাওয়া বরাদ্দপত্রে দেখা যায় শুধু টিকা কেনা ও পরিবহনসহ সাতটি খাতে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। টিকা কেনা, পরিবহন থেকে শুরু করে টিকা দেওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে টাকা চাওয়া হয়েছিল মোট ১৬টি খাতের বিপরীতে এক হাজার ৫৮৯ কোটি ৪৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। সেখানে মাত্র সাতটি খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭১৯ কোটি ৩১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রস্তাব থেকে কাটা গেছে ৮৭০ কোটি ১৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বাজেট-১ শাখা থেকে সিনিয়র সহকারী সচিব সুশীল কুমার পাল গত ১৭ জানুয়ারি এসংক্রান্ত একটি বরাদ্দ মঞ্জুরিপত্র পাঠিয়েছেন চিফ অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসারের কাছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কভিড-১৯ টিকা কেনা-পরিবহন খরচসহ কোল্ড চেইনে পৌঁছানোর জন্য ৭১৯ কোটি ৩১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা চলতি অর্থবছরের বাজেটের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় তহবিল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুকূলে বরাদ্দ মঞ্জুর করা হলো।

এমন অবস্থায় হতাশা প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকা শুধু কিনলেই হবে না, এটা দেওয়া নিয়েই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে মানুষকে উদ্বুব্ধ করার জন্য প্রচারণার কোনো বিকল্প নেই। ফলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যদি প্রচারের জন্য বরাদ্দ না পায় কিংবা স্বেচ্ছাসেবকদের আপ্যায়নের বরাদ্দ না পায়, তারা কিভাবে কাজ করবে। টিকা দিতে নামার আগ থেকেই তো এগুলো অপরিহার্য। এটা ভাবতেই অবাক লাগে, টিকা কেনার জন্য অনেক টাকা খরচ হয়েছে; কিন্তু সেই টিকা দেওয়ার খরচ যদি কেটে দেওয়া হয়, তবে তো টিকাদান কর্মসূচিই ব্যাহত হবে।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, যারা এই টাকা কেটেছে তাদের দূরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। যেসব খাতের টাকা কাটা হয়েছে, সফলভাবে টিকা দেওয়ার জন্য এর সবই জরুরি কাজ। কোনোটা টিকা দেওয়ার আগে, কোনোটা টিকা দেওয়ার সময় আবার কোনোটা টিকা দেওয়া পরের কাজ। বিশেষ করে টিকা ডাটাবেইস আর সার্ভের বরাদ্দ কেটে দেওয়া মানে টিকা দেওয়ার সাফল্য অন্ধকারের মুখে ঠেলে দেওয়ার শামিল।

এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক সূত্র থেকে জানা যায়, এর আগে গত ২০ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৬টি খাতের বরাদ্দ চাহিদার ভিত্তিতে ৯টি খাতে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৭৩৫ কোটি ৭৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা। কিন্তু ১৭ জানুয়ারি ওই বরাদ্দ থেকে আরো দুটি খাতের ১৬ কোটি ৪৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা কেটে দেওয়া হয়েছে। একই কর্মকর্তা দুটি বরাদ্দপত্র পাঠিয়েছেন চিফ অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসারের কাছে। আর সর্বশেষ বরাদ্দের বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জানাজানি হয় গত ২০ ডিসেম্বর দেশে ভারত থেকে উপহারের ২০ লাখ চার হাজার টিকা এসে পৌঁছার পরে। এরপর থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোতে এক ধরনের হা-হুতাশ শুরু হয়। যেভাবে প্রস্তুতি সাজানো হয়েছিল, তার অনেকটাই এলোমেলো হতে শুরু করে। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে দেখা দেয় এক ধরনের অসামঞ্জস্য অবস্থা, যা সামাল দিতে হিমশিম অবস্থায় পড়ে যান দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। রীতিমতো অস্থিরতা ও কান্নাকাটির মতো পরিস্থিতি চলতে থাকে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোতে।

জানতে চাইলে পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা তো চরম বিপাকে পড়ে গেছি। আমরা এমন অবস্থায় পড়েছি যে টিকা দেওয়া শুরু কিভাবে করব, তা-ই বুঝতে পারছি না। আপনারা সবাই আমাদের দুষছেন—আমরা কেন টিকার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাপকভাবে প্রচার চালাতে পারলাম না। কিন্তু এ জন্য তো আমাকে একটি টাকাও দেওয়া হলো না, প্রস্তাব পাঠিয়েছি তা কেটে দিয়েছে, আমি কী দিয়ে কী করব। খরচ পাব কেথায়?’

তিনি বলেন, ‘শুধু কি তাই! ৪২ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে আপ্যায়নের জন্য কিছু টাকা চেয়েছিলাম, সেখানেও একটি টাকা পেলাম না, কেটে দিয়েছে; ডাটাবেইসের জন্য একটি টাকা পেলাম না, পরিস্থিতি দেখার জন্য একটা সার্ভে জরুরি—সেটারও কোনো টাকা পাইনি। কিভাবে কী করব! এখন কি আপ্যায়ন ছাড়া কোনো স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া যায়? টাকা ছাড়া কতটাই বা প্রচার-প্রচারণা হয়, বিজ্ঞাপন কি টাকা ছাড়া হবে?’

বরাদ্দপত্র খুঁজে দেখা যায়, কেটে দেওয়া খাত ৯টির মধ্যে রয়েছে আপ্যায়ন ব্যয়, হায়ারিং চার্জ, প্রচার ও বিজ্ঞাপন, মুদ্রণ ও বাঁধাই, জরিপ, সম্মানী-পারিতোষিক, চিকিৎসা ব্যয় ও ডাটাবেইস। আর বরাদ্দকৃত ৭১৯ কোটি ৩১ লাখ ৪৫ হাজার টাকার মধ্যে রাখা হয়েছে টিকা কেনা বাবদ সর্বোচ্চ ৬২৮ কোটি ৪৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। এরপর পণ্যের ভাড়া ও পরিবহন ব্যয় বাবদ ৭২ কোটি ৭২ লাখ ২৮ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ বাবদ দুই কোটি ৩৬ লাখ ৩১ হাজার টাকা, ভ্রমণ ব্যয় ছয় কোটি ৭৬ লাখ ১৯ হাজার টাকা, চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসাসামগ্রী বাবদ এক কোটি ৯৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, স্বাস্থ্য বিধান সামগ্রী বাবদ তিন কোটি ৩৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, প্রকৌশলী ও অন্যান্য সরঞ্জাম বাবদ তিন কোটি ৬৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

এদিকে অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ আমাদের জানা নেই। স্বাস্থ্য বিভাগ যখন যে প্রয়োজনে যত টাকা চেয়েছে অতিদ্রুত তা ছাড় করা হয়েছে। পরে যদি এমন কোনো বিষয় নজরে আসে, তবে আমরা সে অনুসারে ব্যবস্থা নেব।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/01/26/998719