২৬ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৫৫

বহু দেশে ট্যুরিস্ট ভিসা এখনও বন্ধ পর্যটন খাতে আবারো ধসের আশঙ্কা

করোনা মহামারির কারণে অধিকাংশ দেশের ট্যুরিস্ট ভিসা এখনও চালু হয়নি। বিশেষ করে ট্যুরিস্ট নির্ভর দেশগুলোর ভিসা প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়নি। অন্যদিকে কোনো কোনো দেশ বিশেষ ক্যাটাগরিতে ভিসা চালু রেখেছে। সে কারণে কবে নাগাদ বিভিন্ন দেশের ট্যুরিস্ট ভিসা চালু হবে সেটা কেউই এখনও বলতে পারছেন না। ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ থাকার কারণে ঝুঁকিতে পর্যটন খাত। এদিকে গত কয়েক বছরে পর্যটন শিল্পে উন্নতি চোখে পড়ার মতো। নভেল করোনা ভাইরাসের রাহুগ্রাসের প্রভাবে এ শিল্পে ধস নেমে এসেছে। সব রকম হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, জানুয়ারি ২০২০ থেকে মে মাস পর্যন্ত মোট পাঁচ মাসে সার্বিক পর্যটন শিল্পে ৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং প্রায় ৩ লাখ ৯ হাজার ৫০০ জন তাদের চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। এই বিপর্যয়কর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সরকারের বিশেষ মনোযোগের প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-টোয়াবের পরিচালক মো. শাহেদুল্লাহ।

জাতিসংঘের রিপোর্ট বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ৫৮ থেকে ৭৮ শতাংশ কমেছে পর্যটক। পরিসংখ্যান বলছে, ৮৫ কোটি থেকে ১১০ কোটি কমেছে পর্যটকের সংখ্যা। বছরের প্রথম তিন মাসে এরইমধ্যে ৩২ হাজার কোটি ডলার লোকসান গুনেছে বিশ্বের পর্যটন খাত। তথ্য বলছে, পুরো ২০২০ সালে এ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৯১ হাজার কোটি ডলার থেকে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। এ ক্ষতির পরিমাণ ২০০৯ সালের আর্থিক সংকটের সময়কার ক্ষতির চেয়ে তিনগুণ বেশি।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে ভ্রমণ ও পর্যটন খাতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অপরদিকে প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেলস এসোসিয়েশনের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শিগগিরই পর্যটন স্পটগুলো সীমিত পরিসরে খুলে দেয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মহিবুল হক।

বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, চাকরি হারিয়েছে প্রায় ৭ দশমিক পাঁচ কোটি পর্যটনকর্মী। শুধু পর্যটন খাতে গত বছরের তুলনায় এ বছর আয় কমবে প্রায় ২৬৪ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। ব্যবসা খাতে ভ্রমণ বাবদ ক্ষতির সম্মুখীন হবে ৮১০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। কভিড-১৯ নামের মরণঘাতী এক ভাইরাসের প্রকোপে আজ সারাবিশ্ব প্রকম্পিত। এর পরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুরু হয়েছে প্রায় সব রকমের অর্থনৈতিক কর্ম। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আকাশপথও চালু করছে দেশগুলো। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। অভ্যন্তরীণ রুটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোও ধীরে ধীরে খোলা হয়েছিল বছরের মাঝামাঝি সময়ে, কিন্তু বছরের শেষে শীতকাল শুরু হওয়ায় সারাবিশে^র অভ্যন্তরীণ রুটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোও ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। জীবন জীবিকা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৭০% জনবল। সংখ্যার হিসেবে সেটা ৪০ লাখেরও বেশি। তারা রোজগারহীন অবস্থায় থাকায় তাদের ওপর নির্ভরশীল কমপক্ষে দেড় কোটি মানুষ কঠিন বিপদের মধ্যে আছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। সরকারি সহায়তার ক্ষেত্রে এখনও সম্ভাবনাময় এই খাতটি উপেক্ষিত থেকে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, গত বছর এপ্রিল মাস থেকে করোনা মহামারির প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে প্লেন চলাচল ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ ভিসা প্রক্রিয়াও বন্ধ রাখে। তবে করোনা পরিস্থিতির প্রকোপ কমে আসায় বেশ কয়েকটি দেশ বিভিন্ন ক্যাটাগরির ভিসা প্রক্রিয়া স্বাভাবিক করলেও ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ রাখে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় মাপের ভূমিকা পালন করছে পর্যটনশিল্প। পরিসংখ্যান এটাই জানিয়ে দিচ্ছে, বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যাদের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আসে পর্যটন শিল্প হতে। কারণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্যবিমোচন এবং বিনিয়োগ ক্ষেত্রে এ শিল্পের অসামান্য অবদান রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রযুক্তিবান্ধব পর্যটন বদলে দিতে পারে অর্থনীতি। কারণ পর্যটন বর্তমান বিশ্বের একক বৃহত্তম এবং দ্রুত সম্প্রসারণশীল শিল্প। বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে এ শিল্পের বিকাশ হয়েছে অকল্পনীয়ভাবে। ১৯৫০ সালে যেখানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের সংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন মাত্র যা ৬০ বছরের ব্যবধানে ২০১৭ সালে এসে দাঁড়িয়েছে এক হাজার মিলিয়ন। একই সময়ে পর্যটন শিল্প থেকে আয়ের পরিমাণ ছিল ১৯৫০ সালে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০১৭ সালে এসে এক হাজার মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যাদের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আসে পর্যটনশিল্প হতে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্যবিমোচন এবং বিনিয়োগ ক্ষেত্রে এ শিল্পের অসামান্য অবদান রয়েছে।

করোনা মহামারির জন্য ভারতের ট্যুরিস্ট ভিসা এখনও চালু হয়নি। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর পর্যটকদের একটি বৃহৎ অংশ ভারতে গিয়ে থাকেন। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে পছন্দ করেন অনেক বাংলাদেশি। তবে করোনা মহামারির কারণে এখনও ভারতের ট্যুরিস্ট ভিসা চালু হয়নি। কবে নাগাদ ভারতের ট্যুরিস্ট ভিসা চালু হবে সেটাও কেউ সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে পারছেন না।

ঢাকাস্থ মালয়েশিয়া হাইকমিশন গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, করোনার কারণে মালয়েশিয়ার ট্যুরিস্ট ভিসা এখনও চালু হয়নি। মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় দফায় করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেশটির মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার (এমসিও) এখনও অব্যাহত রয়েছে। আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত এমসিও চালু থাকায় দেশটিতে এখনও ট্যুরিস্ট ভিসা চালু হয়নি। কবে নাগাদ চালু হবে, সেটা এখনও কেউ বলতে পারছেন না।

বাংলাদেশি ট্যুরিস্টদের অন্যতম গন্তব্য সিঙ্গাপুরের ট্যুরিস্ট ভিসা এখনও চালু হয়নি। এছাড়া করোনা মহামারির কারণে সিঙ্গাপুরে শর্ট টার্ম ভিজিটরদের জন্য কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে সিঙ্গাপুরে শর্ট টার্ম ভিজিটরদের জন্য এয়ার ট্রাভেল পাস লাগবে। একই সাথে ৩০ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার মূল্যের বিমা করতে হবে।

করোনার কারণে থাইল্যান্ডের ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ ছিল। তবে চলতি মাসের ১০ জানুয়ারি থেকে থাইল্যান্ড ট্যুরিস্ট ভিসা প্রক্রিয়া চালু করেছে। ভিসার ক্ষেত্রে থাইল্যান্ড নতুন শর্ত আরোপ করেছে। সেই শর্ত অনুযায়ী ভিসা প্রার্থীকে এক লাখ মার্কিন ডলারের বিমা করতে হবে। একই সাথে থাই ভিসা ছাড়াও থাইল্যান্ডে প্রবেশের অনুমতির জন্য সার্টিফিকেট অব এন্ট্রি নিতে হবে। ঢাকা থেকে ব্যাংককের সরাসরি ফ্লাইট এখনও চালু হয়নি। সে কারণে ঢাকা থেকে থাইল্যান্ডে যেতে হলে দুবাই অথবা দোহা হয়ে যেতে হবে বলে জানিয়েছে ঢাকাস্থ থাইল্যান্ড দূতাবাস। এছাড়া সেখানে গিয়ে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।

ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, করোনা মহামারির কারণে ভারতের ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ রয়েছে। ভারতের ট্যুরিস্ট ভিসা কবে চালু হবে, এখনই সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলা সম্ভব নয়। ভিসা চালুর বিষয়টি আমার হাতে নেই। তবে এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও কাজ করছে। ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ থাকলেও মেডিক্যাল ও বিজনেস ভিসা চালু রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

সামগ্রিক বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা কবে নাগাদ নিয়ন্ত্রণে আসবে কোনো দেশই কিন্তু বলতে পারছে না। তাই ভিসা প্রক্রিয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। করোনার শুরুর দিকেই সব দেশের ভিসা প্রক্রিয়া হয়ে যায়। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিভিন্ন দেশ কার্যক্রম শুরু করছে। নতুন করে কিছু দেশের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিসহ দক্ষতামূলক বিভিন্ন খাতে ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণের জন্যও চেষ্টা করা হচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিলের হিসাব মতে, বিশ্বে মোট কর্মসংস্থানের ৮ শতাংশ পর্যটন খাতে হয়ে থাকে। একই সময়ে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ বিশ্বের মোট বিনিয়োগের ১১ শতাংশ হারে বাড়ছে।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা যায় আফ্রিকার প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে পর্যটনে বিনিয়োগ। পর্যটন শিল্পের জন্য অপরিহার্য যে সব উপাদানের কথা উল্লেখ আছে তা হচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রত্নতাক্তিক নিদর্শন, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্থান, পাহাড়, নদী, অরণ্য, সমুদ্র সৈকত, মানুষের বিচিত্র জীবনধারা, বন্যপ্রাণী, নানা উৎসব ইত্যাদি। এসব উপাদানের সবই বাংলাদেশে বিদ্যমান।

বাংলাদেশে আছে বহু ঐতিহাসিক স্থান, বহু পুরাকীর্তি। আমাদের রয়েছে ময়নামতির বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র, মহাস্থান গড়, পাহাড়পুর, কান্তজির মন্দির, রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন।

পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাব মতে সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। তাইওয়ানের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশ, হংকংয়ের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৫৫ শতাংশ, ফিলিপিন্সের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৩০ শতাংশ। মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই পর্যটন খাতের উপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশের পরতে পরতে ছড়ানো রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, হাজার বছরের বৈচিত্রময় সংস্কৃতির সমাহার ও অপার নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের হাতছানি। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে জাতীয় পরিকল্পনায় পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান, জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিকল্পিত প্রচার চালানো, দেশের ইতিবাচক ভাবর্মূতি প্রতিষ্ঠা ও পরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রয়োজন। প্রয়োজন বেসরকারি উদ্যোক্তাদরে উৎসাহিত করা। এ জন্য তাদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা ও ট্যাক্স মওকুফ করা, সর্বোপরি পর্যটন তহবিল গঠন করা প্রয়োজন।

https://dailysangram.com/post/441724