২৫ জানুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১০:৩৮

রডের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে বিক্রি কম ॥ নির্মাণ কাজে স্থবিরতা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : গত বছরের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক মাসের ব্যবধানে এমএস রডের দাম ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আগের সব রেকর্ড ভেঙে এবার বিশ্ববাজারে বাড়ছে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম। যার প্রভাবে দেশের বাজারে নির্মাণ খাতের অন্যতম অনুসঙ্গ রডের দামও বাড়ছে লাগাতার। দুই থেকে আড়াই মাস আগে এক টন রডের দাম যেখানে পড়ত ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকা সেখানে বর্তমান দাম পড়ছে ৬৮ হাজারের ওপরে। বিক্রেতারা দিনের বেশিরভাগ সময়ই দোকান খুলে বসে থাকেন ক্রেতার অপেক্ষায়। তাদের হিসাবে নভেম্বরের আগের তুলনায় এখন রডের দাম বেড়েছে ৩৬ শতাংশের বেশি। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে নির্মাণ কাজ। এমএস রডের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে রড ব্যবহারকারীরা। তারা বলছে, রডের অস্বাভাবিক এ মূল্যবৃদ্ধি থামাতে না পারলে বেসরকারির পাশাপাশি সরকারের নির্মাণকাজও স্থবির হয়ে পড়বে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নও ব্যাহত হতে পারে।

দেশে ইস্পাতশিল্প খাতে রডসহ সব ধরনের উৎপাদিত পণ্যের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। একক খাত হিসেবে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় এই খাতে। বছরে রডের চাহিদা ৫৫ লাখ টনের বেশি। এই হিসাবে মাসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টন রড দরকার হয়, শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা আরও বেশি। সে অনুযায়ী হিসাব করে দেখা যায়, টনপ্রতি গড়ে ১১ হাজার টাকা বাড়লে প্রতি মাসে গ্রাহকদের বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে ৫০০-৫৫০ কোটি টাকা। রডের ব্যবহার হয় ব্যক্তি খাতে বাড়ি ও অবকাঠামো নির্মাণ, সরকারি খাতে অবকাঠামো এবং আবাসন খাতে ভবন নির্মাণে। রডের দাম বাড়ায় মোটা দাগে এই তিন খাতেই ব্যয় বাড়ছে। তবে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যে রডের দাম দুই শতাংশ কমার হিসাব দিলেও বাজারে তার প্রভাব পড়েনি।

জানা গেছে, করোনা মহামারির শুরুতে সারা দেশে নির্মাণকাজ প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছিল। তাতে অন্যতম নির্মাণ উপকরণ রডের চাহিদাও ব্যাপক হারে কমে যায়। বিপাকে পড়ে তখন কোম্পানিগুলোও পণ্যটির দাম কমায়, যদিও চাহিদা ছিল কম। মহামারির ধাক্কা সামলে মাস দুয়েক আগে থেকে অনেকেই নির্মাণকাজে হাত দিতে শুরু করেন। সরকারি-বেসরকারি নানা প্রকল্পের কাজও পুরোদমে শুরু হয়। এতে চাহিদা বেড়ে যায়। এই সুযোগে রডের দাম বাড়িয়ে দেয় কোম্পানিগুলো। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে উৎপাদকেরা বলছেন, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম দেড় মাসে টনপ্রতি ১০০ ডলার বেড়েছে। চাহিদানুযায়ী কাঁচামালও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে দাম বাড়ার কারণ যেটাই হোক, তাতে কিন্তু কপাল পুড়েছে মূলত ব্যবহারকারীদের। কারণ, রডের ব্র্যান্ডভেদে যে পরিমাণ দাম বেড়েছে তাতে নির্মাণকাজের খরচ কয়েক শতাংশ বাড়বে। চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেট এলাকায় ‘নজরুল ট্রেডিং’ বিএসআরএম ও আবুল খায়ের কোম্পানির রড বিক্রি করছে। বিক্রেতারা জানান, ভালো ব্র্যান্ডের রডের দাম টনপ্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বেড়ে গেছে।

পুরান ঢাকার বংশাল ও নয়াবাজারে রড ব্যবসায়ীরা জানান, অবকাঠামো উন্নয়নের অন্যতম অনুসঙ্গ এই নির্মাণ সামগ্রীর বিক্রি কমেছে অনেক। তাদের হিসাবে, দুমাস আগে যে পরিমাণ রড বিক্রি হয়েছে বর্তমানে তা নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। কারণ জানতে চাইলে দি প্যারাডাইজ এন্টারপ্রাইজের কর্মকর্তা জানান, রডের দাম বাড়ছে। তাই কেনা কমিয়ে দিয়েছেন ক্রেতারা। দুই থেকে আড়াই মাস আগে এক টন রডের দাম যেখানে পড়তো ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকা সেখানে বর্তমান দাম পড়ছে ৬৮ হাজারের ওপরে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই তারা দোকান খুলে বসে থাকেন ক্রেতার অপেক্ষায়। তার হিসাবে রডের দাম বেড়েছে ৩৬ শতাংশের বেশি।

পুরান ঢাকার মেসার্স নিউ আকবর স্টিল হাউজের সত্ত্বাধিকারী মো. আমির হোসাইন রাজিব জানান, যেভাবে প্রতিদিন দাম বাড়ছে তাতে আর কেউ নতুন করে বাড়িঘর নির্মাণে হাত দিচ্ছেন না। আবার যারা আগে কাজ শুরু করেছেন তাদেরও আর রড কিনতে দোকানে আসতে দেখা যাচ্ছে না। এখন বিক্রি নাই বললেই চলে। রডের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সম্পর্কে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন রিহ্যাবের সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়ার জানান, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়লে তা আসলে দিন শেষে টানতে হয় ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের। তাই এই রডের দাম বৃদ্ধির প্রভাবও পড়বে ক্রেতাদের ওপর।

ঠিকাদারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্সট্রাকশন- বাসির সভাপতি প্রকৌশলী এস এম খোরশেদ আলম জানান, এভাবে রডের দাম হঠাৎ বাড়তে থাকায় চলমান কাজ সময়মতো শেষ করা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন তারা। কাজে এরইমধ্যে ধীরগতি নেমে এসেছে। তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কারণ, তারা যখন টেন্ডার জমা দিয়েছিলেন সেখানে এই নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়তে শঙ্কায় বর্ধিত মূল্য নির্ধারণের সুযোগ ছিলো না। অথচ এখন বর্ধিত দামে কিনতে হচ্ছে। এই প্রকৌশলী জানান, বর্তমানে স্ক্র্যাপের দাম বাড়ছে; এটা ঠিক। কিন্তু তারপরও সময় ও দামের ঊর্ধগতির বিবেচনায় রডের এই পরিমাণ দাম বৃদ্ধিকে যৌক্তিক মনে করছেন না তিনি।

দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টিল প্রস্তুতকারকদের সংগঠনের মহাসচিব মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্প প্রায় পুরোপুরি আমদানি নির্ভর কাঁচামালে চলে। এবার বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ছে অনেক বেশি। বিশ্ববাজারে ইস্পাত তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম না কমলে দেশের বাজারে রডের দাম কমার কোন সম্ভাবনা নেই বলে জানান তিনি। আবার দাম বৃদ্ধির প্রবণতায় সহসাই স্ক্র্যাপের দাম কমার কোন ইঙ্গিতও দেখছেন না তিনি। স্টিল মিল কারখানা প্রাঙ্গণে আগের মতো আর স্ক্র্যাপের মজুদ নেই। তবে তাদের সংগ্রহে যে পরিমাণ স্ক্র্যাপ আছে তা দিয়ে তাদের দৈনিক উৎপাদন সচল রাখতে কোন সমস্যায় পড়তে হবে না।

জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে (ভাংরির দোকান) রড প্রস্তুতকারকরা তাদের বাৎসরিক চাহিদার প্রায় ২০ ভাগ পেয়ে থাকেন। আর স্বাভাবিক সময়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে পান ১০ শতাংশের মতো। বাকিটা তাদের আমদানি করতে হয়। দেশে বর্তমানে রডের চাহিদা ৬০ লাখ টন। এর বিপরীতে দেশিয় স্টিল মিলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৯০ লাখ টন। অর্থাৎ দেশের চাহিদা দেশের মিলগুলোর মেটানোর সক্ষমতা রয়েছে। ভ্যাট ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান নানান অসঙ্গতি দূর করতে পারলে আন্তর্জাতিক বাজারে যাই ঘটুক না কেন বর্তমান পরিস্থিতিতেও দেশের বাজারে রডের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

রডের দাম বাড়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারেরাও বিপাকে পড়েছেন। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের নির্মাণ ঠিকাদার বুলবুল আহমেদ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের গাইডওয়ালসহ সড়ক ও সেতু নির্মাণের একটি প্রকল্পের কাজ করছেন। তিনি জানান, কুষ্টিয়ায়ও রডের দর লাফিয়ে বেড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হয়েছে। অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। কারণ, যেভাবে খরচ বেড়েছে, তাতে লাভ তো দূরের কথা নিজের পকেট থেকে টাকা দিতে হবে। ক্রেতারা জানান, গত বছরের অক্টোবর থেকে রডের চাহিদা বাড়ছিল। নভেম্বরে নির্মাণকাজের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় কোম্পানিগুলো রডের দাম বাড়িয়েছে। এতে নির্মাণকাজ কমে গেছে। বিক্রেতারা বলছেন, শীত মৌসুম শুরু হওয়ার পর চাহিদা বাড়ছিল। তবে দাম বাড়ার পরপরই বেচাবিক্রি কমে গেছে। সবাই দাম কমার অপেক্ষায় আছেন।

উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রড তৈরির কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরার দাম ছিল প্রতি টন ৩০৭ ডলার। ডিসেম্বরে তা বেড়ে ৪০৬-৪১০ ডলারে উঠেছে। সেই হিসাবে প্রতি টন কাঁচামালের দাম বেড়েছে প্রায় সাড়ে আট হাজার টাকা। আবার বিশ্বজুড়ে কনটেইনারের সংকটের কারণে এখন ঋণপত্র (এলসি) খুলেও সময়মতো পণ্য হাতে পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। এমন সংকটের সময়ে রপ্তানিকারক দেশ চীন এখন নিজেই আমদানি করছে। দুই বছরের আমদানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে তারা লোহা তৈরির কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি করছে। এতে খাতটিতে আরও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেনগুপ্ত জানান, করোনার আগে যদি রডের মূল্য তুলনা করা হয়, তাহলে দাম বেড়েছে। রডের কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকায় কোম্পানিগুলো এখন মূল্য সমন্বয় করছে। একই কথা জানিছেন রড উৎপাদনে শীর্ষ সারির আরেক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের কর্মকর্তা।

এদিকে এমএস রডের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে রড ব্যবহারকারীরা। তারা বলছে, রডের অস্বাভাবিক এ মূল্যবৃদ্ধি থামাতে না পারলে সরকারের নির্মাণকাজ স্থবির হয়ে পড়বে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নও ব্যাহত হতে পারে। সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন রড ব্যবহারকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) নেতারা। রডের দাম কমাতে তাঁরা পাঁচ দফা সুপারিশও করেছেন। সম্মেলনে বলা হয়, গত নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক মাসের ব্যবধানে এমএস রডের দাম ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বিএসিআইয়ের নেতারা বলছেন, হঠাৎ কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই রডের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এতে করে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের গতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই দাম নিয়ন্ত্রণে পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে পিপিআর অনুযায়ী দাম সমন্বয়ের ব্যবস্থা চালু, সরকারি কাজের মূল্য সমন্বয় করা, সব ধরনের শুল্ক-কর সমন্বয় করা, সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে অতি দ্রুত শুল্কবিহীন রড আমদানির উদ্যোগ নেওয়া ও বর্তমান বাজারদরের ভিত্তিতে গণপূর্তের কাজের মূল্য হালনাগাদ করা।

বর্তমান নির্মাণ খাত, তথা কনস্ট্রাকশন শিল্প দেশের পঞ্চম বৃহত্তম শিল্প খাত। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় সোয়া ১০ শতাংশ। দেশের সাড়ে তিন কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু হঠাৎ করে রডের মূল্যবৃদ্ধি এ শিল্পকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। আগের সব রেকর্ড ভেঙে এবার বিশ্ববাজারে বাড়ছে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম। যার প্রভাবে দেশের বাজারে নির্মাণ খাতের অন্যতম অনুসঙ্গ রডের দামও বাড়ছে লাগাতার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে। রড তৈরির মৌলিক কাঁচামাল স্ক্র্যাপ আমদানিতে উচ্চ শুল্ক ধরা আছে। এটি কমাতে হবে। রড তৈরির আরেকটি কাঁচামাল হচ্ছে বিলেট। মধ্যবর্তী এই কাঁচামালের শুল্কও কমাতে হবে। সবশেষ স্ক্র্যাপ আমদানির ওপর আগাম ভ্যাট ও অগ্রিম কর উভয়ই প্রত্যাহার করতে হবে। এসব ব্যবস্থা নিলে রডের কাঁচামাল সহজলভ্য হবে এবং দেশীয় বাজারে দাম কমে আসবে বলে জানান তারা।

https://dailysangram.com/post/441604