গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে নিয়ম ভেঙে এক নারীর সঙ্গে সাজাপ্রাপ্ত বন্দীর নিবিড় সময় কাটানো ঘটনার কিছু দৃশ্য -ছবি সংগৃহীত
২৪ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১১:৩৩

কারা কর্মকর্তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে তোলপাড়

কারাবন্দী অবস্থায় নারীসঙ্গ জঘন্যতম অপরাধ -স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
দুটি তদন্ত কমিটি গঠন
নাছির উদ্দিন শোয়েব : গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে নিয়ম ভেঙে এক নারীর সঙ্গে সাজাপ্রাপ্ত বন্দীর নিবিড় সময় কাটানোর ঘটনায় তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরা হলেন- ডেপুটি জেলার মোহাম্মদ সাকলাইন, সার্জেন্ট আব্দুল বারী ও সহকারী প্রধান কারারক্ষী খলিলুর রহমান। জেল সুপার রত্না রায়কেও প্রত্যাহার করা হতে পারে বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।

এদিকে ঘটনা তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন- কারাবন্দী অবস্থায় নারীসঙ্গের ঘটনা জঘন্যতম অপরাধ। অন্যদিকে দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত কারা উপ-মহাপরিদর্শক বজলুর রশিদকে জনস্বার্থে দায়িত্বে ফিরিয়ে আনতে চাওয়ার প্রস্তাবে বিস্ময় জানিয়ে খতিয়ে দেখারও আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

জানা গেছে, করোনা মহামারির মধ্যে কারাগারের বন্দীদের সঙ্গে কোনো দর্শনার্থীর সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ। এ অবস্থায় অনেক ভিআইপি বন্দীও দীর্ঘ দিন ধরে কারাগারে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারছেন না। ঠিক এই সময়ে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১ এ বন্দী থাকা আর্থিক খাতের বড় কেলেঙ্কারির প্রতিষ্ঠান হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের ভায়রা ও হলমার্কের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমেদের সঙ্গে কারাগারের অভ্যন্তরে এক নারীর সঙ্গে তার একান্তে সময় কাটানোর একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। প্রথমে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ফুটেজটি প্রকাশিত হলে তা নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সেটি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে।

এদিকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ডেপুটি জেলার মোহাম্মদ সাকলাইন, সার্জেন্ট আব্দুল বারী ও সহকারী প্রধান কারারক্ষী খলিলুর রহমানকে প্রত্যাহার করে কারা সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন জানিয়েছেন, এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও কারা কর্তৃপক্ষ দুটি তদন্ত কমিটি করেছে। একইসঙ্গে তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট যেকোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও অতি দ্রুতই প্রত্যাহার করা হতে পারে।

ওই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গত ৬ জানুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের পার্ট-১ এ বন্দী হলমার্ক কেলেঙ্কারির হোতা মালিক তানভীরের ভায়রা কোম্পানির জিএম তুষারের সাথে এক নারী সাক্ষাৎ করেন। ডেপুটি জেলার সাকলাইন সাক্ষাতের অনুমতির জন্য ১২টা ২২ মিনিটে সুপারের রুমে প্রবেশ করেন। সুপারের রুম থেকে অনুমতি নিয়ে ১২টা ৪০ মিনিটে বের হন সাকলাইন। ১২টা ৫৬ মিনিটে ওই নারী কারাগারে প্রবেশ করেন। সিসিটিভিতে দেখা যায়, ডেপুটি জেলার সাকলাইন ১২টা ৫৭ মিনিটে কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করে ১টা ০৪ মিনিটে তুষারকে সাথে নিয়ে ওই নারীর সাথে সাক্ষাৎ করতে একটি কক্ষে নেন। ১টা ১৫ মিনিটে জেল সুপার কারাগার থেকে বের হয়ে যান। এরপর তুষার একটি কক্ষে প্রায় ৪৬ মিনিট সময় কাটায় ওই নারীর সাথে।

এ ঘটনায় কারাগারের ডেপুটি জেলার সাকলাইন একটি গণমাধ্যমকে জানান, ‘সুপার স্যারের অনুমতিতেই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। তিনি বলেন, আমার কি ক্ষমতা আছে, জেলের ভেতর থেকে আসামী নিয়ে আসবো। গেট অর্ডার, যৌথ বাহিনী, হাবিলদার, সুবেদার আছে। আমি একাই আসামী নিয়ে আসলাম। ভিডিও ফুটেজে তাকেই আসামী নিয়ে আসতে দেখা যাওয়ার বিষয়টি তুললে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমিই তো নিয়ে এসেছি। এটা তো অস্বীকার করছি না। আমাকে বলেছে তাই আমি আনতে গেছি। আমাকে না বললে তো আর আমি আনতে যেতাম না’।

গাজীপুর প্রতিনিধি রেজাউল বারী বাবুল জানান, গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিএম) আবুল কালাম বলেন, ওই ঘটনায় গত ১২ জানুয়ারি গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-গাজীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে হাবিবা ফারজানা ও মো. ওয়াসিউজ্জামান চৌধুরী। জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ওই ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। এদিকে কারা অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক মো. আবরার হোসেনকে। ২১ জানুয়ারি তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অন্য দুই সদস্য হলেন- কারা অধিদপ্তরের উপসচিব (সুরক্ষা সেবা বিভাগ) মো. আবু সাঈদ মোল্লাহ ও ডিআইজি (ময়মনসিংহ বিভাগ) মো. জাহাঙ্গীর কবির। অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক মো. আবরার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ঘটনার তদন্তকালে ওই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তদন্ত শেষে বিষয়টি জানানো হবে।

কারাবন্দী অবস্থায় নারীসঙ্গ জঘন্যতম অপরাধ : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, কারাবন্দী অবস্থায় নারীসঙ্গের ঘটনা জঘন্যতম অপরাধ। কারাগারের ভেতরে এ ধরনের ঘটনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। বিধি অনুযায়ী শাস্তি পাবে অভিযুক্তরা। যেই এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকবে, বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল শনিবার তিনি এসব কথা জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এরই মধ্যে অভিযুক্ত তিন জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

ডিআইজি বজলুর রশিদের বিষয়ে বিস্মিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : এদিকে দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত কারা উপ-মহাপরিদর্শক বজলুর রশিদকে জনস্বার্থে দায়িত্বে ফিরিয়ে আনতে চায় কারা অধিদপ্তর। ১২ জানুয়ারি কারা মহাপরিদর্শক মো. মোমিনুর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়া এক চিঠিতে তার বদলি বা পদায়নের প্রস্তাব করেন। এমন প্রস্তাবে বিস্ময় জানিয়ে খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তবে কারা অধিদপ্তরের দাবি, বজলুর রশিদকে চাকরিতে ফেরাতে নয়, তার পদে নতুন কাউকে আনতেই বদলির সুপারিশ।

কুরিয়ারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে গত ২০ অক্টোবর দুদকে তলব করা হয়, কারা সদর অধিদপ্তরের ডিআইজি বজলুর রশিদকে। জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালেই প্রায় সোয়া ৩ কোটি টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে মামলা করে বজলুর রশিদকে গ্রেপ্তার দেখায় দুদক। পরে তাকে কারগারে পাঠানো হয়। কিন্তু ১২ দিনের মাথায়ই বিচারিক আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দেয়। তবে, মামলায় চলায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ মামলায় অভিযোগ গঠন হয়ে বিচারকাজ শুরু হয়েছে। তবে, কারা অধিদপ্তর হঠাৎ করেই বজলুর রশিদকে বরিশাল বিভাগীয় কারা উপমহাপরিদর্শকের দপ্তরে বদলি বা পদায়ন এবং একই সঙ্গে কারা অধিদপ্তর ঢাকায় সংযুক্ত করার প্রস্তাব করে। এ সুপারিশে অবাক খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলছেন, দুর্নীতির মামলার অভিযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি তথ্য গোপন করে জামিন নিয়ে আরেকটি অপরাধ করেছেন তিনি। এর মধ্যে তাকে চাকরিতে ফেরানো প্রস্তাব পুরোপুরি আইনবিরোধী। অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল আবরার হোসেন বলছে, অভিযুক্ত কর্মকর্তার ওপর কোনো দরদ দেখানো হয়নি। কারা সদর দপ্তরে ডিআইজির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে কেউ সাময়িক বরখাস্ত থাকলে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়।

https://dailysangram.com/post/441544