২৩ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ২:৪৯

উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা

দুই বছর ধরে চলমান অভিযানে দখলদারমুক্ত হয়নি বুড়িগঙ্গা অপরিকল্পিত উচ্ছেদের নামে চলে ইঁদুর বিড়াল খেলা : স্থপতি ইকবাল হাবিব গত দুই বছর যেসব স্থান দখলমুক্ত করেছি তা পুনর্দখল হয়নি : নৌপ

ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা। দখল আর দূষণে এক সময়ের প্রাণোচ্ছ্বল বুড়িগঙ্গা নদী এখন মৃত-প্রায়। দুইকূল ঘেঁষে অবৈধ দখলের কারণে বুড়িগঙ্গা নদী ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়েছে, কমছে প্রশস্ততা। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বুড়িগঙ্গার দুই পাড় দখল করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ইটভাটাসহ নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। নদী ভরাট করে অনেকে ইট-বালুর জমজমাট ব্যবসা করছে। নদীকে জীবন্তসত্ত্বা আখ্যা দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বুড়িগঙ্গার জীবন ফিরিয়ে দিতে দখল ও দূষণমুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের এই নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না। বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) কোটি কোটি টাকা খরচ করে মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। তবে উচ্ছেদের পর তা আবার পুনঃরায় দখল হয়ে যায়। এভাবে উচ্ছেদের নামে চলে ইঁদুর বিড়াল খেলা। আর এতে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার পকেটভারি হয়। ফলে উচ্ছেদের কোনো সুফল পাওয়া যায় না।

বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব এ বিষয়ে গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বুড়িগঙ্গাকে দখলমুক্ত করার উচ্ছেদ অভিযান গত এক বছর ধরে চলছে। বিআইডব্লিউটিএ অবৈধ কিছু স্থাপনা উচ্ছেদ করে ফেলে রাখে। কিছুদিন পর এটা আবার পুনঃরায় দখল হয়ে যায়। এটা অনেকটা ইঁদুর বিড়াল খেলার মতো। এতে একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা লাভবান হয়। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে এর সুফল পাওয়া যাবে না। নদীর সীমানা নির্ধারণের নামেও অসাধু কর্মকর্তারা নদীর অনেক জায়গা অবৈধ দখলদারদের ছেড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই হাইকোর্টের নির্দেশমতে, সিএস অনুযায়ী নদীর সীমানা আগে নির্ধারণ করে, পরে সে অনুযায়ী উচ্ছেদ করতে হবে। আর উচ্ছেদের পর এটা রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। লোকবলের অভাবের কথা বলে উচ্ছেদের পর যথাযথ তদারকি করতে পারে না বিআইডব্লিউটিএ এমনটা বলে থাকে। তবে বর্তমান ডিজিটাল যুগে ক্যামেরা বসিয়ে জুমের মাধ্যমে উচ্ছেদকৃত স্থান সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা সম্ভব। তাই আন্তরিকভাবে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলে এবং পরবর্তীতে তা রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হলে নদীকে তার জায়গা ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব।

উচ্ছেদের পরও কেন বুড়িগঙ্গা আবার দখল হচ্ছে? জানতে চাইলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত আছে এবং থাকবে। গত দুই বছর আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে যেসব স্থান দখলমুক্ত করেছি তা পুনঃদখল হয়নি। উচ্ছেদ করা জায়গা আমরা সংরক্ষণ করছি। সীমানা পিলার দেয়া হয়েছে, ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে, বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে। এভাবে আমরা উদ্ধারকৃত জায়গা পুরোপুরি সংরক্ষণ করছি। আরও যে সব স্থান উদ্ধার হবে সেসব স্থানে নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ অন্যান্য কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হবে।
দখলের কারণে বুড়িগঙ্গা ঢাকার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। জানা গেছে, দীর্ঘ দুই যুগ ধরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার শাখা নদীর প্রায় ২৪ হাজার ৫০০ কাঠা (৩৫০ একর) দখল করে নিয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও ভূমিদস্যুরা। যার অনুমানিক মূল্য ৫০০ কোটি টাকার বেশি।

বুড়িগঙ্গা নদীর আদি চ্যানেল (হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর) সিএস-আরএস অনুসারে জরিপ করে দখলমুক্ত করতে গত বছর ১২ অক্টোবর উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে দখলদারদের নাম-ঠিকানাসহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশনায়, জরিপ সম্পন্নের জন্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে (ডিজি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জরিপ টিমে ঢাকা জেলা প্রশাসক, বিআইডব্লিউটিএ’র প্রতিনিধিও রাখার কথা বলা হয়েছে।

ওই রায়ের আলোকে বিআইডব্লিউটিএ নদী দখলমুক্ত করার কাজ শুরু করেছে। হাজারীবাগ-কামরাঙ্গীরচর এলাকার বুড়িগঙ্গা নদীর অংশ উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান চলছে। গত কয়েবকদিন ধরে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে বুড়িগঙ্গার তীর দখল করে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে দ্বিতীয় দফায় অভিযান শুরু হয়েছে। এতে বুড়িগঙ্গা দখল করে গড়ে তোলা কয়েকশত অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অভিযানে উচ্ছেদ করা অবৈধ স্থাপনার মধ্যে পাঁচতলা ভবন, চারতলা, দোতলা ভবন রয়েছে। এছাড়া টিনশেড, স’মিল, সিমেন্টের গোডাউনসহ নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। কেরানীগঞ্জের মধ্যেরচর খেয়াঘাট এলাকায় গত বছর ২০ ডিসেম্বর অভিযান চালিয়ে এমপি হাজী সেলিমের ছেলে সাবেক কাউন্সিলর ইরফান সেলিমের দখল করে লাগানো সাইনবোর্ড গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জে বছিলা সেতুর পশ্চিমপাশে চর ওয়াশপুর এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীর দখল করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করেছেন ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হক। গত বছর ৪ মার্চ সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ। তবে এমপি উপস্থিত হয়ে বাধা দিলে তা দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

গত দুই বছর ধরে বুড়িগঙ্গায় বিআইডব্লিউটিএ’র উচ্ছেদ অভিযান চলছে। গত বছরও টানা ১১ দিনের উচ্ছেদ অভিযানে প্রায় দুই হাজার স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এর মধ্যে কয়েকটি বহুতল ভবনও ছিল। তবে সেসব উচ্ছেদের কয়েকমাস পর তার বেশিরভাগই আবার পুনঃদখল হয়ে যায়। কামরাঙ্গীরচর ও সদরঘাটের আশপাশের দুই পাড়েই গড়ে উঠেছিল শতাধিক স্থাপনা। বিআইডব্লিউটিএ’র এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এর আগে সদরঘাট, সোয়ারীঘাট, বাদামতলী, ওয়াইজঘাটসহ আশপাশের এলাকার শত শত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদকৃত জায়গায় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, সেখানে ওয়াকওয়ে ও বাগান তৈরি করা হবে। এ ছাড়া থাকবে পার্কিং ইয়ার্ড। তবে এসব পরিকল্পনা বস্তবায়ন করতে অনেক স্থানে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। এরই মধ্যে পুরান ঢাকার বাদামতলী ও সোয়ারীঘাটে উচ্ছেদকৃত অনেক স্থানে কয়েকটি স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, উচ্ছেদের পরদিন থেকে বিআইডব্লিউটিএ’র অসাধু কর্মচারীদের ম্যানেজ করে কতিপয় ব্যবসায়ী দোকান বসিয়ে ব্যবসা করছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এলে তাদেরকে সরিয়ে দেয়া হয়।

একই চিত্র নদীর দক্ষিণপাড়ে কেরানীগঞ্জের আঁটি ও খোলামোড়া থেকে শুরু করে জিনজিরা, কালিগঞ্জ, মাদারীপুর, লসমনগঞ্জ, বরিশুর, মান্দাইল, আগানগর, পার গেন্ডারিয়া, মিরেরবাগ ও হাসনাবাদ এলাকার। এসব এলাকাতেও গড়ে তোলা হয়েছে বহুসংখ্যক টংঘরসহ কাঁচাপাকা স্থাপনা। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ’র একশ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারী এসব অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। প্রতিটি টংঘর থেকে মাসে দুইশ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা এবং অন্যান্য স্থাপনা থেকে আয়তন ও স্থানের গুরুত্ব ভেদে পাঁচশ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।

নদীর চারপাশে সিমেন্টের তৈরি ছোট ছোট পিলার আছে যা কিনা বুড়িগঙ্গার সীমানা নির্ধারণ করেছে। এই সীমানা পিলার থাকার পরেও বুড়িগঙ্গা অবৈধভাবে দখল করছে বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষায় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছি। সরকার বিভিন্ন সময় বুড়িগঙ্গা রক্ষায় প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও মাঝপথেই তা থেমে যায়। কার্যকর সুফল আমরা পাচ্ছি না। ফলে প্রাণপ্রিয় বুড়িগঙ্গা আজ মৃত্যুর মুখে। কিন্তু ঢাকার জনগণকে বাঁচানোর স্বার্থে বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করা খুবই জরুরি। তাই বুড়িগঙ্গা রক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার যদি নদী রক্ষায় আন্তরিক থাকে তাহলে নদী দখল হবে না। কারণ দখলদার হয় বড় বড় প্রভাবশালী যারা। আর উচ্ছেদের প্রক্রিয়ায় দেখা যায় ছোট সবজি ব্যবসায়ী ওদের উচ্ছেদ করা হয় দ্রুততার সাথে। কিন্তু কোনো বড় ফ্যাক্টরি বা বড় দখলদার আজ পর্যন্ত উচ্ছেদের কোনো নজির আমরা দেখিনি।

https://www.dailyinqilab.com/article/352299