২৩ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ২:৪০

পেঁয়াজ সবজিতে রাজধানীবাসীর স্বস্তি ফিরলেও কৃষকের মাথায় হাত

পেঁয়াজ আর সবজিতে রাজধানীবাসীর স্বস্তি ফিরলেও দাম না পেয়ে কৃষকের মাথায় হাত। উৎপাদন খরচও উঠছে না চাষিদের। কাঁচাবাজারে সরবরাহ বাড়ায় কমেছে সবজির দাম। রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় হাতের নাগালে সবজি পাওয়ায় বাজারে ক্রেতা কমেছে বলে জানান বিক্রেতারা। অস্বাভাবিক বাড়ার পর ভোজ্যতেলের খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম কিছুটা কমেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। তবে বোতলজাত সয়াবিন তেল আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। তবে মাছের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। দাম বেড়েছে দেশি মুরগীর। সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন প্রকার মাছ ও দেশি মুরগী কেজিতে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এখনো অস্থিরতা রয়েছে চালের বাজারে।

জানা গেছে, ২০১৯ ও ২০২০ সালে পেঁয়াজের অতিরিক্ত দাম ভুগিয়েছে ভোক্তাদের। ভারতের হঠাৎ রপ্তানি বন্ধে দেশের বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়। হু হু করে বেড়ে যায় পেঁয়াজের দাম। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৩০ টাকার পেঁয়াজ সপ্তাহের ব্যবধানে সেঞ্চুরী করে ফেলে। ক্রেতাদের দীর্ঘদিন ধরে ভুগিয়েছে পেঁয়াজ। তার আগরে বছরও একই সময়ে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে ৩৫ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজের দাম ৩০০ টাকার রেকর্ডে পৌঁছে যায়। জরুরি ভিত্তিতে বিমানযোগে পাকিস্তান, তুরস্ক ও মিশর থেকে আমদানি করে সরবরাহ পরিস্থিতি সামাল দিলেও এর খেসারত ক্রেতা সাধারণকেই দিতে হয়েছিল সাত-আট গুণ বেশি মূল্যে পেঁয়াজ কিনে।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে সপ্তাহ ব্যবধানে প্রায় সব সবজির দামই কমছে। কারওয়ান বাজার, মগবাজার, মহাখালি ও মালিবাগের কাঁচাবাজারে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা কমে কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। কেজিতে ১০ টাকা করে কমেছে মুলা, শসা, বেগুন, আলু, শিমের দাম। তবে, ৫-১০ টাকা বেড়েছে লেবু, টমেটো আর করলার দাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরান ঢাকা, নিউমার্কেট, আজিমপুর এবং হাজারিবাগের সবজি বাজারগুলোতেও আগের তুলনায় সবজির দাম আরও কমেছে। শীতের সবজির ভরা মৌসুম ও ঢাকার আশপাশের গ্রামাঞ্চল থেকে চাহিদার তুলনায় বেশি যোগান থাকায় সবজির বাজারে এই স্বস্তি বিরাজ করছে। বিক্রেতারা জানান, বাজারে সবজির সরবরাহ রয়েছে পর্যাপ্ত। তবে, বিক্রি কমেছে। দামের ব্যাপারে ক্রেতারাও সন্তুষ্টির কথা জানান।

এ সব বাজারে পাকা টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ২০-৩৫ টাকা, শিম ২০-২৫ টাকা, ফুলকপি ও বাঁধাকপির পিস বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ২০ টাকা, গাজর ৩০-৪০ টাকা, বেগুন ২০-৩০ টাকা, মুলা ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বড় লাউ ৩০ থেকে ৪০ টাকা, নতুন আলুর কেজি ২০-৩০ টাকা, শালগম ২০ টাকা, কুমড়া ২০ টাকা, ব্রকলি ২০-৩০ টাকা, পেঁপের কেজি ২০-২৫ টাকা, কাঁচা কলা প্রতি হালি ১৫-২০ টাকা, লেবু প্রতি হালি ৩০ টাকা, পেঁয়াজ পাতা ১০ টাকা আঁটি, এছাড়াও ৩০ টাকা কেজিতে দেশি পেঁয়াজ, মিসরের পেঁয়াজ ২৫ টাকা, দেশি আদা ৭০ টাকা, চীনা আদা ১৬০ টাকা এবং ভারতীয় রসুন ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

তবে কিছুটা বেড়েছে মাছের দাম। এসব বাজারে বড় কাতল বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা কেজি দরে। বড় রুইয়ের দাম পড়ছে সাড়ে ৩০০ টাকা কেজি। আইড় এক হাজার, দেশি পুঁটি ৫০০ পাবদা সাড়ে ৩০০, মেনি (ভেদা) ও টেংরা ৪০০, রূপচাঁদা ৭০০ আর চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা কেজি দরে। এসব মাছের দাম সপ্তাহ ব্যবধানে বেড়েছে কেজিতে ৩০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া প্রতি কেজি গরুর গোশত ৫৮০ টাকা আর খাসির গোশত বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৮০০ টাকায়। তবে, কিছুটা বাড়তি দেশি মুরগির দাম। কেজির হিসাবে সপ্তাহ ব্যবধানে দেশি মুরগির দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ টাকা। গরু-খাসির মতোই স্থিতিশীল রয়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম, প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকার মধ্যে। প্রতি হালি হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা। এছাড়া বয়লার মুরগি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, সোনালি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, লেয়ার ১৭০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। হাঁসের পিছ ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা এবং কবুতর ১২৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

অস্বাভাবিক বাড়ার পর ভোজ্যতেলের খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম কিছুটা কমেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। তবে বোতলের সয়াবিন তেল আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১২০-১২৫ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৩০-১৩৫ টাকা। পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১১৫-১২০ টাকা। অপরদিকে, বোতলের সয়াবিন তেল নাম ভেদে ১১০ থেকে ১২০ টাকাতেই বিক্রি হচ্ছে। কোম্পানিভেদে বোতলের পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের মূল্য তালিকা নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৬৬৫ টাকা। তবে খুচরা পর্যায়ে বোতলের পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল ৫৬০-৬০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহের ব্যবধানে বোতলের সয়াবিন তেলের দামের পরিবর্তন হয়নি।

চালের বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতি কেজি মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫৯ থেকে ৬০ টাকা, নাজিরশাইল ৫২ থেকে ৬৫ টাকা, স্বর্ণা ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা ও আটাশ ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। নবাবগঞ্জের আড়তদাররা জানান, এখন মৌসুমের শেষ। এজন্য চালের দাম বাড়ছে। তবে চালের সংকট রয়েছে এমনও নয়। একটা গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে বাজার অস্থির করছে। সরকার এখানে নজর দিলেই দাম কমে যাবে।

এদিকে ফলন ভালো, উৎপাদন খরচও ভালো, ভালো নয় শুধু বিক্রয়মূল্য। এমন মন্তব্যেই রাজধানীর পাইকারি বাজারে লোকসান গুনে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা চাষিরা। শুক্রবার রাজধানীর শ্যামবাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করতে আসা শরীয়তপুরের আরিফ জানান, তিনি এবার ৪ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছেন। প্রতি বিঘা চাষে তার খরচ হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা করে। ফলন পেয়েছেন ৫৫ মণ করে। অর্থাৎ প্রতিমণ পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ পড়েছে এক হাজার টাকা। আর শ্যামবাজারে এসে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করছেন ২৩ টাকা ৭০ পয়সা দরে। অর্থাৎ এক মণ পেঁয়াজ বিক্রি করে তিনি হাতে পাচ্ছেন ৯৪৮ টাকা। অর্থাৎ পরিবহন খরচ দিয়ে শরীয়তপুরে জাজিরা থেকে শ্যামবাজারে এসে পেঁয়াজ বিক্রি করে লোকসান গুনে বাড়ি ফিরছেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে পেঁয়াজ চাষ করে আসছেন রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার মো. রমজান মোল্লা। তিনি জানান, গত বছরও লাভের মুখে দেখেই বছর পার করেছেন এই পেঁয়াজ চাষি। এবার তাকে লোকসানের মুখে ঠেলে দিয়েছে তার ৭ বিঘা জমির পেঁয়াজ। তার হিসাবে ফলন ভালো হয়েছে এবার। বিঘাপ্রতি তারও খরচ পড়েছে ৫৫ হাজার টাকা। অথচ প্রতি মণ বিক্রি করে পাচ্ছেন ৪২ হাজার থেকে ৪৩ হাজার টাকা। তিনিও পরিবহন খরচ দিয়ে পণ্য বাজারে নিয়ে এসে লোকসানের মুখে পড়েছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের চাহিদার প্রায় সবটুকু পেঁয়াজই যায় এই শ্যামবাজার থেকে। বাজারের বিভিন্ন আড়ত ঘুরে পাওয়া গেল চাষিদের লোকসানের হিসাবের সত্যতা। এ বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে দেশির পেঁয়াজের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু দাম কমছে লাগাতার। দু’দিন আগের তুলনায় কেজিতে ২-৩ টাকা কমেছে। আরও কমবে, বাজার এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে। তবে, এই বাজারের কোনো আড়তে ভারতীয় পেঁয়াজ নেই। কারণ, দাম দেশি পেঁয়াজের প্রায় দ্বিগুণ। তবে, অল্প পরিমাণে রয়েছে তুরস্ক আর হল্যান্ডের পেঁয়াজ। যেগুলোর দাম ও চাহিদা দেশি পেঁয়াজের তুলনায় বেশ কম।

সবজির দামেও উঠছেনা উৎপাদন খরচ। কারওয়ান বাজারে সবজি বিক্রি করতে আসা কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কৃষকের কাছ থেকে নাম মূলে সবজি কিনে আনলেও পরিবহন খরচ খুবই বেশি। ফলে কেজিতে দাম একটু বেশি পড়ে গেছে। এখানে এসে ক্রেতা সংকট দেখা দেওয়ায় কম মূল্যে বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে আমাদেরও লোকসান হচ্ছে।

https://dailysangram.com/post/441452