২৩ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ২:৩৮

বিজাতীয় সংস্কৃতির সয়লাব, দায় কার?

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। অথচ আমাদের এই নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ভূলুন্ঠিত করছে বিজাতীয় সংস্কৃতি। এ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে না পারলে দেশীয় সংস্কৃতির ইতিহাসের বিলুপ্তি ঘটবে। তখন তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাস জানতে হলে জাদুঘরে যেতে হবে। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে! বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন ঠেকাতে ব্যর্থ হলে উন্নয়নের তকমা তখন কাজে লাগবে না। উন্নয়নই একটি দেশের সবকিছু না। এর বাইরেও আরো সূচক আছে। সেগুলোর অবস্থা কী? ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, যখনই পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে সামরিক আগ্রাসন চালানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে তখন কৌশলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হতো। এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে সাংস্কৃতির আগ্রাসনের মাধ্যমে বিদেশী শক্তি সেদেশের জনগণের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে দুর্বল করে দিত। যেন সামরিক আগ্রাসন চালানো সহজ হয়ে যায়। আমরা যদি ভারতবর্ষের ইতিহাসের দিকে তাকাই সেখানেও দেখবো আধিপত্যবাদীরা সামরিক আগ্রাসন চালানোর আগে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়েছে।

দেশ আজ আর নিজস্ব সংস্কৃতিতে চলতে পারছে না। এটা নতুন করে কাউকে বুঝানোর দরকার নেই। কারণ পত্রিকার পাতায় চোখ ভুলালে কিংবা টিভিতে সংবাদ দেখতে বসলেই সামনে উপস্থিত হয় একটির পর একটি লোমহর্ষক ঘটনা। প্রচার হতে থাকে বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া খুন, হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, মাদকাসক্তি, এসিড নিক্ষেপ, সম্ভ্রমহানির ঘটনা। এগুলোকে আমরা নোংরা সংস্কৃতির বিষফল বলতে পারি। একটি দেশ বা জাতির পচন শুরু হয় তার সংস্কৃতি থেকে। ভারতীয় সংস্কৃতির দাপটে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি হাবুডুবু খাচ্ছে। দেশের সংস্কৃতিপ্রেমীরা সংস্কৃতির বিকাশধারা সমুন্নত রাখার চেয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা হওয়ার অসম প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এদিকে ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে পড়েছে। সে ব্যাপারে কারও মাথা ব্যথা নেই। ঘরে ঘরে ভারতীয় সংস্কৃতির ছড়াছড়ি। ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসায় যা দেখানো হচ্ছে তা সুস্থসমাজ ও পরিবার গঠনের অন্তরায়। কারণ এসব নাটক ও সিরিয়াল কূটনামী এবং পরকীয়াকে উৎসাহিত করছে। এসব সিরিয়ালের নষ্টতার প্রভাব আমাদের দেশেও বাড়ছে। তা না হলে ঢাকায় দিনে ৩৯ বিবাহ বিচ্ছেদ হবে কেন? এটি আমার কথা নয়। গত ২১ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে ঢাকায় দিনে ৩৯ বিবাহ বিচ্ছেদ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব সিরিয়াল আমাদের পরিবার গঠনকে মজবুত করে তা কিন্তু নয়! উল্টো আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ভেঙ্গে যাচ্ছে। অথচ একটা সময় এমন ছিল যে পরিবারে সবাই এক সাথে বসবাস করতে উৎসাহবোধ করতো। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। বউ আর শাশুড়ি একত্রে বসবাস করতে পারছে না। যে পরিবারে মানুষ বেশি থাকে সে পরিবারের সাথে কেউ আত্নীয়তা করতে চাচ্ছে না। সবাই একা একা থাকতে পছন্দ করছে। এই পরির্বতন সমাজের জন্য সুখকর নয়!

সংস্কৃতির কাজ হচ্ছে ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকে জীবনবোধ ও বাস্তব জীবনকে সুন্দর করা। কিন্তু চলমান বিজাতীয় সংস্কৃতি আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। সংস্কৃতির অঙ্গনে এখন আর সংস্কৃতি কর্মীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করছে না। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃত্ব সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের হাত থেকে ফস্কে ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। মৌলবাদের গন্ধ লেগে যাবার ভয়ে কিছু মানুষ নিজের বিশ্বাসকে আড়াল করে বিশ্বাসী মানুষদের সংস্পর্শ এড়িয়ে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে আধুনিকতার নামে সমাজ তথা পরিবারে লালন করছেন। কেউ যদি জোর করে কারো দেহের পোশাক টেনে খুলে ফেলে আমরা এটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করি। আবার একই কাজ কেউ যদি স্বেচ্ছায় করে তাহলে এটাকে আর অপরাধ হিসেবে দেখি না, কিন্তু কেন? আমাদের সংস্কৃতিকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হয়েছে বলেই কি যুবতী মেয়েরা দেহের আবরণ আপত্তিকর রকম সংক্ষিপ্ত পোশাক পড়ে জনসমক্ষে আসে। অথচ এক শ্রেণীর মায়েরা যখন বাইরে যান তখন বোরখা পড়ে যান। কিন্তু তার যুবতী মেয়েকে যখন বাইরে পাঠান তখন আঁটসাট পোশাক পড়িয়ে পাঠান। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আমরা বিবেকবান বাবা-মায়েদের কাছে শালীনতা আশা করি।

দেশীয় সংস্কৃতির বারোটা বাজানোর ক্ষেত্রে সবাই কম-বেশি দায়ী। কিন্তু সরকারের দায়টা একটু বেশী। সরকার ইচ্ছে করলে অনেক কিছুকে পরিবর্তন করতে পারে। যা আমরা পারি না। আমরা লিখতে পারি। প্রতিবাদ করতে পারি। ওই পর্যন্তই শেষ। কিন্তু সরকার বিজাতীয় সংস্কৃতির বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে পারেন। সরকার যদি আইন করেন ভারতীয় চ্যানেল আমাদের দেশে চলবে না। বিজ্ঞাপনে নারীকে অশ্লীল পোশাকে উপস্থাপন করা যাবে না। অশ্লীল ছবি, অশ্লীল ওয়েবসিরিজ, অশ্লীল নাটক চলবে না। তাহলে কার সাধ্য আছে অশ্লীলতার পক্ষে ওকালতি করার। অথচ একই অনুষ্ঠানে কিংবা একই মুভি বা বিজ্ঞাপনে একজন ছেলে তার শরীরের চেয়ে প্রয়োজনীয় ঢিলেঢালা পুরো মাপের পোশাক পরিধান করছে। প্যান্ট-গেঞ্জী, শার্ট কোনোটাই তার শরীরে লেপ্টে থাকছে না। অথচ একজন যুবতী মেয়ে শরীরের সাথে লেগে থাকা সংক্ষিপ্ত, বড়গলা, খোলাপিঠের মশারি জালের মত পোশাক পরিধান করেছ। কেউ বাধা দিচ্ছে না। কারণ এটা নাকি স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা নারীর সম্ভ্রমকে হুমকির মধ্যে ফেলে দেয় সে স্বাধীনতা যুবতী নারীর জীবনে কতটুকু দরকার তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

কোনো কোনো পশ্চিমা সরকার মাথার স্কার্ফসহ অন্যান্য ইসলামী আচরণ ও পোশাককে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতির বিপরীত মনে করে নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে। পশ্চিমা সমাজ ভিনদেশীয় সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধ করতে পারলো। কিন্তু আমরা দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে ভিনদেশীয় সংস্কৃতিকে বিতাড়িত করতে পারলাম না। আমাদের সৎ সাহস,সদিচ্ছা আর স্বচ্ছচিন্তার এত অভাব কেন? তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। স্কুল-কলেজ পড়ুরা ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়ে অভিভাবকেরা পড়ে আছেন মহাবিপাকে।

ছেলে স্কুল পালিয়ে সাইবার ক্যাফেতে ঢুকে পড়ছে কিনা অথবা মাদকাসক্ত বন্ধুর পাল্লায় পড়ে যাচ্ছে কিনা এই চিন্তায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙিনায়ও তাদেরকে পাহারা দিতে হচ্ছে। ইন্টারনেট ব্রাউজিং সারাক্ষণ পাহারা দেয়া যেমন অভিভাবকদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি সহপাঠীদের মধ্যে মোবাইলে আপত্তিকর ছবি আদান প্রদান বন্ধ করাও সম্ভব হচ্ছে না। স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও আমাদের অভিভাকদের হাতে নেই। বাজারে ছেয়ে থাকা অশ্লীল পত্রিকা উপন্যাসও তারা বন্ধ করতে পারছে না। গুলিস্তান, নীলক্ষেত, সদরঘাটের কথা না হয় বাদই দিলাম! কিছু লাইব্রেরিতে টানিয়ে রাখা বইয়ের প্রচ্ছদের দিকে তাকানো যায় না। বুকস্টলগুলোতে পিন-আপ ম্যাগাজিনে ছেয়ে গেছে। এই বইগুলো উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা ক্রয় করছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে অশ্লীল বই অশ্লীল সিডি বিক্রি করলেও তারা ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। কারণ এগুলো চুরি-ডাকাতি কিংবা সন্ত্রাসের আওতাভুক্ত নয়! কিন্তু নৈতিকতা হত্যা কী সন্ত্রাসের চেয়ে কম? ফেনসিডিল, গাঁজা, আফিম, ইয়াবা তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে আমাদের যুব সমাজকে। মাদক ব্যবসায়ী চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করা কি এতই কঠিন? সৎ লোকের অভাব আছে জানি।

কিন্তু সদিচ্ছার অভাব যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন আর দঃখের সীমা থাকে না। এদিকে প্রচার মাধ্যমগুলোতে চলছে বিকৃত রুচির গণতন্ত্র। জনগণের গণতন্ত্র নির্বাসিত। সুস্থ সংস্কৃতির জন্য আমরা রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে শালীনতা বিবর্জিত বিলবোর্ড সিনেমার অশ্লীল বিজ্ঞাপন টানিয়ে রাখা হচ্ছে, যার ফলে একজন বাবা তার যুবতী মেয়েকে নিয়ে পাশ দিয়ে যেতে পারছেন না লজ্জায় ভয়ে। বিবেকে কষ্টের ঝাঁকুনি লাগে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের কি কেউ নেই? আরেকটু রুচিশীলতার পরিচয় কি দেয়া যায় না? নোংরামীকে একটু একটু করে প্রশয় দিতে দিতে ক্রমেই অপসংস্কৃতির কাদায় আটকে যাচ্ছি আমরা। আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতি এমন ভ্রকুটি আর কতকাল সহতে হবে?

https://dailysangram.com/post/441448