২৩ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ২:৩৬

বন্দুক যুদ্ধেও থামছে না মাদকের ভয়াবহতা

নাছির উদ্দিন শোয়েব : মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যুদ্ধ ঘোষণা করলেও থেমে নেই মাদকের ভয়াবহতা। মাদক কারবারীরা এখনো সক্রিয়। দেশে মাদকদ্রব্যের সেবন ও কেনাবেচা কমছে না। বিশেষ করে ইয়াবার চালান উদ্ধার বেড়েই চলছে। র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, ও গোয়েন্দারা মাদক নির্র্মূলে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও বিপুল পরিমানে মাদক ঢুকছে দেশে। সীমান্ত এলাকা থেকে মাদকের চালান পৌঁছে যাচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

২০১৮ সালের ৪ মে ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ শিরোনামে অভিযান শুরু করে র‌্যাব। দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। ওই অভিযানে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ২৭২ জন। এতে দুই নারীসহ ১০৪ জন রোহিঙ্গা নাগরিকও রয়েছেন। শুধু টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান ১৬২ জন। অভিযানের আড়াই বছরের বেশি সময় পর এসে সরকারি সংস্থাগুলোই বলছে, দেশে মাদকের সরবরাহ ও মজুত কমেনি, বরং বেড়েছে।

সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বিজিরি সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে আবদুর রহিম (২৫) নামের এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়েছেন। বিজিবির দাবি, নিহত আবদুর রহিম মাদক কারবারি ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, মাদক নির্মূলে বিশেষ অভিযান অব্যাহত আছে। এখনো র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো বড় চালানও উদ্ধার হচ্ছে। বিশেষ করে টেকনাফ সীমান্ত থেকে ইয়াবার চালান বেশি উদ্ধার হচ্ছে। পুলিশ বলছে, এখন মাদকের চালান বাইরে বেশি যাচ্ছে না; আটক হচ্ছে বেশি। এ অভিযান চলমান আছে।

গত বছর ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হন। এরপর ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দেশজুড়ে করোনা প্রতিরোধে লকডাউন চলে। এ সময় পণ্যবাহী ও জরুরি সেবায় যুক্ত পরিবহন ছাড়া অন্য সব গণপরিবহন বন্ধ ছিল। ট্রাক, কুরিয়ার সার্ভিস ও নিত্যপণ্যের গাড়িতে মাদকের ছোট-বড় চালান আটক করে পুলিশ, র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। করোনা মহামারির মধ্যেও নানা কৌশলে মাদকের চালান আসছে।

জানা গেছে, মাদকদ্রব্যের মধ্যে আবার ইয়াবা চালান আসছে সবচেয়ে বেশি। এ সব ইয়াবার বেশিরভাগই কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া টেকনাফ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকেও ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। মাদক অধ্যুষিত এলাকা সমূহে বিজিবি টহল আরও বেশি জোরদার করা হয়েছে। তা ছাড়া বিজিবির রাত্রিকালীন টহলও বাড়ানো হয়েছে।

তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অভিযানের আড়াই বছরের বেশি সময় পর এসে দেশে মাদকের সরবরাহ ও মজুত কমেনি, বরং বেড়েছে। ২০২০ সালে জাতীয় মাদকবিরোধী কমিটির এক সভায় এ বিষয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন সংস্থার মাদকবিরোধী অভিযানে ৬ লাখ ৭ হাজার ৪৫১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৩৬২টি মামলা হয়েছে।

এদিকে গত বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে পুলিশ, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, র‌্যাব ও কোস্ট গার্ড মিলে নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবা উদ্ধার করেছে ২ কোটি ৯৬ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৫ পিস। এছাড়াও এই সময়ে দেশে আরও ৩০ কোটি পিস ইয়াবা ঢুকেছে। সূত্রমতে, মিয়ানমারে প্রতি পিস ইয়াবার দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় গড়ে ৩০ টাকা। এই হিসাবে উদ্ধার হওয়া ও উদ্ধারের বাইরে থাকা প্রায় ৩৩ কোটি পিস ইয়াবার মূল্য ৯৯০ কোটি টাকারও বেশি, যা গত ১১ মাসে পাচার হয়েছে মিয়ানমারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিজিবির তথ্য মতে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ২০২০ সালে (১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত) দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে সর্বমোট ৭৩৭ কোটি ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন প্রকারের চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। জব্দকৃত মাদকের মধ্যে রয়েছে এক কোটি আট লাখ ৮৯ হাজার ৮৪৯ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬৯ বোতল ফেনসিডিল, এক লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ বোতল বিদেশি মদ, ছয় হাজার ৩৩৯ লিটার বাংলা মদ, ১০ হাজার ৪১৬ ক্যান বিয়ার, ১৩ হাজার ৮৫৭ কেজি গাঁজা, ২২ কেজি ১৭ গ্রাম হেরোইন, ৪৬ হাজার ৬২১টি উত্তেজক ইনজেকশন, ৬৪ হাজার ১৬৯টি এ্যানেগ্রা/সেনেগ্রা ট্যাবলেট এবং ৩০ লাখ ২৪ হাজার ৯টি অন্যান্য ট্যাবলেট। বিদায়ী বছরে ২০২০ সালে শুধু বিজিবি দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে ১ কোটি ৮ লাখ ৮৯ হাজার ৪৪৯টি ইয়াবা উদ্ধার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। গত ডিসেম্বর মাসেই ১০ লাখ ২৬ হাজার ২১০টি ইয়াবা উদ্ধার করেছে বাহিনীটি। বিজিবি বলছে, এত মাদক ধরার কারণে দেশে মাদক অনেকটা কম বিক্রি হয়েছে। সঠিক নজরদারির কারণে এসব মাদক জব্দ করা সম্ভব হয়েছে।

বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, যে পরিমাণ চোরাচালান পণ্য উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে মাদকদ্রব্য সবচেয়ে বেশি। এত পরিমাণ মাদক উদ্ধারের পরেও সারাদেশের তরুণ সমাজ ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। এসব মাদক জব্দ না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারত। বিজিবি আইন মেনে সীমান্ত এলাকায় মাদক উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রাখবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যমতে, সব সংস্থা মিলে ২০০৯ সালে ১ লাখ ৩২ হাজার ২৮৭ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এরপর ২০১৪ সালে উদ্ধার করা হয় ৬৫ লাখ ১২ হাজার ৮৬৯ পিস। ২০১৫ সালে বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে উদ্ধার হয় ২ কোটি ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮১ পিস, ২০১৭ সালে ৪ কোটি ৭৯ হাজার ৪৪৩ পিস, ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। আর সদ্য বিদায়ী ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ২ কোটি ৯৬ লাখ ৪৫ হাজার ২৫৩ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যানে বোঝা যায়, দেশে ইয়াবার জোগান বেড়েই চলছে।

অন্যদিকে ২০২০ সালে শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশই (ডিএমপি) রাজধানী থেকে ২৮ লাখ ২ হাজার ৪৯৫টি ইয়াবা উদ্ধার করেছে। ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ২০২০ সালে করোনাকালীন মানুষের সেবার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সমানভাবে কাজ করে গেছে ডিএমপি। মাদকবিরোধী অভিযানে বছরজুড়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

https://dailysangram.com/post/441450