২২ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ২:৩৩

চাল আমদানি করেও উল্টো ফল

আমদানির খবরে গত সপ্তাহ থেকে সব ধরনের চালের দাম এক-দুই টাকা করে কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু আমদানি ও সরবরাহের ধীরগতিতে চলতি সপ্তাহে থেমে গেছে সেই ধারা। উল্টো আমদানি করা কয়েক প্রকারের মোটা চালের দাম বাড়তি থাকায় বেড়েছে দেশীয় এ ধরনের চালের দাম। চলতি সপ্তাহে বেড়েছে কেজিতে দুই-তিন টাকা। মাঝারি ও সরু চালের দামও প্রত্যাশিত মাত্রায় না কমে, দম ধরে আছে। বাজার ও ব্র্যান্ডভেদে দু-এক টাকা কমলেও তাতে সন্তুষ্ট নন ক্রেতারা।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারি পর্যায়ে বা জিটুজি ভিত্তিতে ভারত থেকে স্বর্ণা, গুটিসহ কয়েক জাতের মোটা চাল আমদানিতে প্রতি মেট্রিক টনের দাম পড়ছে ৪০৭ ডলার অর্থাৎ ৩৪.৫১ টাকা কেজি। আর আতপ প্রতি টনের খরচ পড়েছে ৪১৭ ডলার, কেজিতে ৩৫.১৬ টাকা। সে হিসাবে খুচরা বাজারে আসতে আসতে দাম বেড়ে যাচ্ছে কেজিতে ১০ টাকার বেশি।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, আমদানি করা এসব চাল পাইকারি দরে কেনাতেই কেজিতে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা পড়ছে তাঁদের। খুচরা বাজারে এসব চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি ৪৫ থেকে ৪৭ টাকা।

অন্যদিকে বাজার ঘুরে দেখা যায়, দেশীয় স্বর্ণা ও গুটিজাতীয় মোটা চাল পাওয়া যাচ্ছে ৪৩ থেকে ৪৬ টাকা কেজি। এই দামও গত সপ্তাহের তুলনায় কেজিতে দুই-চার টাকা বেশি। দেশে চাল আমদানি শুরু হলে গত সপ্তাহে এসব চালের দাম কমে ৪১ থেকে ৪২ টাকায় নেমেছিল।

এ ছাড়া গত সপ্তাহে মাঝারি ও সরু চালের দামও কেজিতে দুই-তিন টাকা পর্যন্ত কমে আসে। চলতি সপ্তাহে আর নতুন করে কমেনি এসব চালের দাম। গত সপ্তাহের দামেই বিক্রি হচ্ছে। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৭ থেকে ৬৪ টাকা। এসব চাল ৬০ থেকে ৬৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে সপ্তাহ তিনেক আগেও।

আমদানি ও সরবরাহের ধীরগতির কারণে দেশীয় চালের বাজারে যে প্রভাব পড়ার কথা, সেটা না পড়ে বরং উল্টোটা ঘটছে। বিক্রেতারা বলছেন, আমদানির চাল দ্রুত ও পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজারে এলে এবং দাম কম হলে চালের বাজার নিম্নমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা না হলে দেশীয় চালের দামও আবার বেড়ে যাবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মুগদা, মানিকনগর, সেগুনবাগিচা, মালিবাগসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, ভারত থেকে আনা স্বর্ণা, গুটি, আটাশসহ কয়েক ধরনের মোটা চাল দু-একটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে। এসব চালের দাম বেশি হওয়ায় এবং সরবরাহকারীরা অগ্রিম টাকা চাওয়ায় বাকিরা রাখেননি।

মুগদা বাজারের মরিয়ম স্টোরের মালিক মো. ইসহাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে আমদানির খবরে চালের দাম কমতে থাকলে ভয়ে কম দামে চাল বিক্রি করে দোকান খালি করে ফেলেছিলাম। দুই দিন যেতেই দেখি মোটা চালের দাম বস্তায় ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেড়ে গেছে। যে হারে বলা হয়েছিল সে হারে আমদানির চাল আসছে না। এলেও দাম বেশি।’

একই বাজারের শাহজালাল রাইস স্টোরের মালিক মিঠু বলেন, ‘আমার কাছে স্যাম্পল (নমুনা) নিয়ে এসেছিল, কিন্তু চালের মান আর অগ্রিম টাকা চাওয়ায় রাখতে পারিনি।’

চাল আমদানির প্রক্রিয়া প্রায় দুই মাস আগে শুরু হলেও গতকাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী সরকারি দরপত্রে আমদানির প্রথম ৫০ হাজার টন চালের মধ্যে মাত্র ২৮ হাজার টন চাল দেশে এসেছে। এরপর বেসরকারি পর্যায়েও চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমদানিকারকরা চাল এনেছেন কি না তা খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জানাননি। যদিও আমদানির অনুমতিপত্রে দেশে চাল আসামাত্র মন্ত্রণালয়কে জানানোর নির্দেশ রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, গত ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে দুই লাখ ৬০ হাজার টন চাল কেনার দরপত্র দেওয়া হয়েছে। আর সরকারি পর্যায়ে ভারত থেকে আসবে দেড় লাখ টন চাল। অর্থাৎ সরকারিভাবে মোট চার লাখ ১০ হাজার টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জিটুজি পদ্ধতিতে ভারত থেকে চাল চলতি মাসেই আসা শুরু করবে বলে আশা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে ঠিক কবে আসতে পারে নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি।

অন্যদিকে বেসরকারিভাবে গত সোমবার পর্যন্ত ১০ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে কী পরিমাণ চাল দেশে এসে পৌঁছেছে তার হিসাব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।

ব্যবসায়ীরা আমদানির তথ্য জানান না উল্লেখ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে, ব্যবসায়ীরা চাল এনে বিক্রি শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার অনুমতির জন্য আসেন। নিয়ম অনুযায়ী চাল আমদানির তথ্য জানান না। এর কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, আমদানি শুল্কজনিত একটি জটিলতার কারণে বেসরকারি আমদানিকারকদের চাল আমদানিতে সমস্যা হচ্ছিল, এটা সমাধান হয়ে গেছে। এ কারণে সময় একটু বেশি লাগছে।

তবে কৌশলগত কারণেও আমদানিকারকরা তথ্য জানান না বলে কর্মকর্তারা জানান। তাঁরা বলেন, দেশে চালের দাম এখন বাড়তি থাকায় কম দামে আমদানি করে বেশি দামে বিক্রি করতে পারার সুযোগ নিতে পারেন ব্যবসায়ীরা। আমদানির তথ্য যদি ফলাও করে প্রচার হয় তাহলে দেশীয় মজুদকারীরাও বাজারে চাল ছেড়ে দিলে দাম অনেক কমে যাবে। এসব কৌশলের ক্ষেত্রেও এক ব্যবসায়ী থেকে অন্য ব্যবসায়ী এগিয়ে থাকতে চান।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে, দেশে চার দফা বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে আমন মৌসুমে ধানের উৎপাদন সাড়ে ১০ শতাংশ কম হয়েছে। অর্থাৎ সাড়ে ১৫ লাখ টন ধান কম উৎপাদন হয়েছে। গত মৌসুমে এক কোটি ৫৬ লাখ টন আমন ধান উৎপাদন হয়েছিল। তার পরও দেশে আগামী জুন পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়েও আট লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা জানিয়েছে ব্রি। কিন্তু নভেম্বর থেকেই চাল সংকটের অজুহাতে দেশের বাজারে দাম বাড়তে থাক। এতে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুমতি দিতে থাকে। এ জন্য দুই দফায় ৬২.৫০ শতাংশ থেকে শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।

https://www.kalerkantho.com/online/national/2021/01/22/997470