২২ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ২:১৮

মধ্যম আয়ের দেশের জজবা

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : এশিয়ায় সিঙ্গাপুরের উত্থানের ইতিহাস বিচিত্র। ১৮১৯ সালে সিঙ্গাপুর বৃটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় এই ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্রটি দখল করে নেয় জাপান। কিন্তু ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হলে সিঙ্গাপুর আবারও বৃটিশ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কিন্তু বৃটিশ সরকার ক্রমান্বয়ে সিঙ্গাপুরকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার দেয়। তবে ১৯৬৩ সালে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। কিন্তু সিঙ্গাপুরীয় ও মালয়েশিয়ার প্রধান রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্বে সেখানে গোলযোগের সৃষ্টি হয় এবং সিঙ্গাপুর আলাদা হয়ে যায়। মাত্র ১৩ মাস তারা মালয়েশিয়ার সঙ্গে ছিল। কিন্তু কোনো বিষয়েই তারা পরস্পরকে আস্থায় নিতে পারেনি। ফলে ১৯৬৪ সালে সেখানে দাঙ্গা দেখা যায়। আর সে কারণেই মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমান সিঙ্গাপুরকে মালয়েশিয়া থেকে বহিষ্কার করেন। ফলে ১৯৬৪ সালের ৯ আগস্ট অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। তবে তা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মধ্যে বহু ক্ষেত্রে এখন ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা রয়েছে।

সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হল লি করনে ইয়ে। মাত্র ৭২৫.৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকার দেশটি নিয়ে তিনি কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু লি শক্ত হাতে হাল ধরেন। কী করে সিঙ্গাপুরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা যায়, সে চেষ্টা করতে থাকেন। তার পরের কাহিনী কেবলই উত্থানের কাল। মূলত সিঙ্গাপুর ছিল জেলে আর জলদস্যুদের দেশ। কিন্তু লি শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েই প্রথমে যা করেন, তা হলো দুর্নীতি ও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযান। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো ছাড় দেননি। তিনি তিন দশক ধরে কঠোর হাতে সিঙ্গাপুর শাসন করেন। তার নেতৃত্বেই সিঙ্গাপুর অতি দরিদ্র দেশ থেকে পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশে পরিণত হয়। তার এই সাফল্যের কাহিনী তিনি লিখে গেছেন তার বই ‘ফ্রম থার্ড ওয়ার্ল্ড টু ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড’। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সকল সম্পদ তিনি মোবিলাইজ করেছেন। কীভাবে শিক্ষা বিস্তারের জন্য, ইউনিসেফের টাকার জন্য জাতিসংঘের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। কখনও ফার্স্টক্লাসে ভ্রমণ করেননি। সব সময় ইকোনমি ক্লাসে ভ্রমণ করেছেন। জাতিসংঘের সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য শিক্ষার প্রসারকে কম করে দেখিয়েছেন। আরও অর্থ এনেছেন। তার প্রবৃদ্ধির কথা তিনি বিশ^সমাজের কাছে, জাতিসংঘের কাছে প্রায় সব সময় চেপে গেছেন। এভাবে প্রতিটি টাকার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন লি। মানুষকে কর্মে উদ্বুদ্ধ করেছেন। দুর্নীতিবাজদের দিয়েছেন কঠোর সাজা। ফলে ধীরে ধীরে সিঙ্গাপর পৃথিবীর শীর্ষ ধনী দেশের একটিতে পরিণত হয়েছে।

লি ১৯৯০ সালে স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। তারপরও লি ২০০৪ সাল পর্যন্ত সিনিয়র মন্ত্রী হিসেবে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। সিঙ্গাপুরে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। তা হলে উন্নয়নের উপায় কী? লি তখন শিল্পায়নের কথা ভাবলেন। আর ভাবলেন ব্যবসার কথা। শিল্পায়ন কীভাবে হবে? তার জন্য সরকারি তহবিল থেকে যেমন ঋণ দেওয়া শুরু হলো, তেমনি ১০ জন লোক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগে ঋণদানে আগ্রহী হচ্ছেন।

সরকার ঋণ ও সুদ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের সে ব্যবস্থা করার অনুমতি দিলেন। আর করলেন গৃহনির্মাণ ব্যবস্থা। সিঙ্গাপুরের মানুষ দরিদ্র এবং বস্তিবাসী ছিল। তিনি তাদের ক্রমান্বয়ে আধুনিক গৃহের ব্যবস্থা করে সিঙ্গাপুরকে একটি মেগাসিটিতে পরিণত করেন। শিল্প হওয়ায় চাকরির ব্যবস্থা যেমন হলো, তেমনি গৃহায়ণে হলো ভালভাবে থাকার ব্যবস্থা। সিঙ্গাপুর পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে যেতে থাকলো।

সিঙ্গাপুর নিয়ে এত বড় ভূমিকা দেয়ার কারণ আমাদের মধ্যম আয়ের দেশের জজবা তৈরির জন্য। গত বছর দুই ধরে আমাদের সরকার কেবলই তড়খাচ্ছে যে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছি। সরকারের সে কি বিরাট সাফল্য! অর্থাৎ উন্নতি একেবারে উপচে উপচে পড়ছে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই ততোটা সরল নয়। মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার বিপদ অনেক, সেটা বোঝার ক্ষমতা সরকারের আছে বলে মনে হয় না। সেটা প্রমাণিত হলো, সরকার সম্প্রতি বলেছে, মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা নিতে আমরা আরও দু’বছর সময় চাই। অর্থাৎ এখনই মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই না।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে কোনো দেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয় তখন তাদের ওপর অনেক বোঝা চাপে। যেমন স্বল্পোন্নত বা এলডিসি দেশের জন্য ঋণের সুদ যদি হয় ০ দশমিক ৭৫ শতাংশ, তবে মধ্যম আয়ের দেশের জন্য তা হবে প্রায় সোয়া দুই শতাংশ। অর্থাৎ ঋণের সুদ পরিশোধেই বেরিয়ে যাবে দেশের বিরাট অঙ্কের টাকা। ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। সেটি অনুধাবন করতে সরকারের সময় লাগলো এবং এখন সময় চেয়ে বিশ্বে হাস্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হলো।

একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করছি। আমি তখন প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা লেখকের দায়িত্ব পালন করি। গণশিক্ষা বিষয়ে একটি বক্তৃতা তৈরি করছিলাম। তখন শিক্ষার হার প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে। আমি সেভাবেই লিখছিলাম। তখন আমার ঘরে এলেন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। জানতে চাইলেন, শিক্ষার হার কত হয়েছে লিখছেন? আমি বললাম। তিনি হায় হায় করে উঠলেন। বললেন, শিক্ষার হার এতোটা বেড়েছেÑ সেটা যদি প্রকাশ করেন, তবে ইউনিসেফ তো শিক্ষা সহায়তা কমিয়ে দেবে, বা বন্ধ করে দেবে। আগের ফিগারটাই লিখুন।

তার এ কথার আগে আমি নিজেও বিষয়টি চিন্তা করে দেখিনি। বেশ পরে লি কুয়ান ইউ-এর বই পড়ে জানলাম, ইউনিসেফের সাহায্য অব্যাহত রাখার জন্য তিনি নিজেও তার দেশের শিক্ষার হারের উন্নতি বহুদিন লুকিয়ে রেখেছিলেন, প্রকাশ করেননি। রাষ্ট্র পরিচালনায় দেশের স্বার্থে কিছু কৌশলেরও তো দরকার হয়। শুধু মধ্যম আয়, মধ্যম আয় বলে চেঁচালে কোনো ফায়দা হয় না। পরে পেছনে ফেরার জন্য আবদার করতে হয়।

https://dailysangram.com/post/441328