২০ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:৫৩

হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ

পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রকল্প শুরু হচ্ছে না কাজ

হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে সুনামগঞ্জে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এসবের কাজ শুরুর কোনো আলামত নেই। উপরন্তু আরো প্রকল্প গ্রহণে দৌড়ঝাঁপ করে চলেছে সুবিধাভোগীরা। স্থানীয় একাধিক সংসদ সদস্যের নাম ভাঙিয়ে প্রতিটি হাওরে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

অভিযোগ উঠেছে, সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত চার উপজেলায় মধ্যস্বত্বভোগীরা উপজেলা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কমিটিকে প্রভাবিত করে প্রকৃত কৃষকদের বাদ দিয়ে প্রকল্প গ্রহণে বাধ্য করছে। গত বছর ৭৪৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও এবার এরই মধ্যে ৭৮৭টি প্রকল্প নেওয়া হয়ে গেছে। এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

চলতি বছর ৬১৩ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত, সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ কাজ আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ করার কথা। কিন্তু প্রকল্প গ্রহণে বিলম্ব হওয়ায় যথাসময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে জড়িত জেলা কাবিটা মনিটরিং ও বাস্তবায়ন কমিটি। এই কমিটি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ ডিসেম্বর বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। ওই সময়ে ১০টি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে এখনো কোথাও কাজ শুরু হয়নি। ওই সময় পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণে মাঠপর্যায়ের প্রাক্কলন শেষ করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ড হাওরের ৯৫০ কিলোমিটার এলাকা সার্ভে করে।

ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত জেলা কমিটি গত ১০ জানুয়ারি এক সভায় মিলিত হয়। সভায় জানানো হয়, এ পর্যন্ত ৭৮৭টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এসবের মধ্যে এ পর্যন্ত ২১২টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এবার হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে ৬২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা প্রাথমিক বরাদ্দ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

২০১৭ সালে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ফসলহানির ঘটনায় কাবিটা নীতিমালা বদল করে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প শুরু করে সরকার। এতে জেলা প্রশাসক জেলা কমিটির সভাপতি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় নির্বাহী প্রকৌশলী সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলীর নেতৃত্বে কাবিটা মনিটরিং ও বাস্তবায়ন কমিটি রয়েছে। উপজেলা পর্যায় থেকে হাওরে গিয়ে সুবিধাভোগী, জমির মালিক ও প্রকৃত কৃষকদের নেতৃত্বে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠনের কথা থাকলেও কোথাওই তা করা হয়নি। বরং স্থানীয় সংসদ সদস্যদের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় সুবিধাভোগী প্রভাবশালীদের নিয়ে গণশুনানি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রকল্প থেকে প্রকৃত কৃষকরা বাদ পড়েছেন। এসব অনিয়মের ঘটনায় বিভিন্ন এলাকায় কৃষকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। প্রকল্পে যুক্ত হতে বিভিন্ন এলাকায় লোকজন টাকা নিয়ে ঘুরছে বলে গত শনিবার সুনামগঞ্জ ট্রাফিক পয়েন্টে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে অভিযোগ করেন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা।

শাল্লা উপজেলার হবিবপুর গ্রামের কৃষক নীতীশ পুরকায়স্থ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। এতে বলা হয়, হাওরে তাঁর জমি রয়েছে। কমিটিতে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করা সত্ত্বেও তাঁকে না রেখে জমি নেই এমন একজনকে কমিটিতে ঢোকানো হয়েছে। জাতগাঁও গ্রামের কৃষক এনাম চৌধুরী পিআইসিতে যুক্ত হতে আবেদন করলে এক লাখ টাকা ঘুষ চাওয়া হয়েছে। তাই তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। পিআইসিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রকল্পে যুক্ত করায় কাজে বিলম্ব হচ্ছে বলে মনে করেন হাওর আন্দোলনের নেতারা।

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষক লীগের সদস্যসচিব বিন্দু তালুকদার বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পাচ্ছি একটি মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী পিআইসিতে লোকজন অন্তর্ভুক্ত করতে টাকা নিয়ে ঘুরছে। আমরা সাংগঠনিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্নীতিমুক্তভাবে পিআইসি গঠন করে হাওরের কৃষকের সম্পদ রক্ষায় দ্রুত কাজ শুরুর দাবি জানিয়েছি। কিন্তু এখনো কাজ শুরু না হওয়ায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী কোথাও পিআইসি গঠন হচ্ছে না, বরং টাকা দিয়ে পিআইসিতে লোকজন যুক্ত হওয়ার জন্য লড়াই শুরু হয়েছে। ফলে কাজ শুরু ও প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব হচ্ছে।

হাওরের কৃষক সংহতির সাংগঠনিক সম্পাদক পীযূষ দাস বলেন, ‘শাল্লায় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়েছে। আমরা প্রকৃত কৃষকদের পিআইসিতে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছি।’

হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে যুক্ত জেলা কমিটির সদস্যসচিব ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, পানি বিলম্বে নামার কারণে সার্ভে করতে বিলম্ব হয়েছে। তাই প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদনেও বিলম্ব হচ্ছে। তবে এ মাসেই কাজ শুরু হবে। আর মাঠপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রকল্প গ্রহণে নীতিমালা মানার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/01/20/996755