২০ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:৩৭

সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচনে সহিংসতা

একটি ঘটনারও তদন্ত করছে না ইসি

সিরাজগঞ্জসহ সহিংসতা হয়েছে-এমন পৌরসভার ফলের গেজেট প্রকাশ শুরু * এ পর্যন্ত নির্বাচনি সহিংসতায় অন্তত ছয়জনের প্রাণহানি * তদন্ত করা ইসির কাজ নয়, এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ : ইসি সচিব

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চার ধাপে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে সহিংসতায় এ পর্যন্ত বিজয়ী কাউন্সিলরসহ অন্তত ছয়জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন কয়েকশ।


এসব ঘটনার একটি ঘটনাও তদন্ত করার উদ্যোগ নেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গঠন করা হয়নি কোনো কমিটি। এমনকি বেশ কয়েকটি পৌরসভা নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোটকেন্দ্র দখল বা ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা।

সেগুলোর বিষয়েও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কমিশন। উলটো সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহের শৈলকূপা, কুষ্টিয়াসহ যেসব পৌরসভা নির্বাচনে রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় মানুষ মারা গেছে, সেসব নির্বাচনের ফলাফলের সরকারি গেজেট প্রকাশের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে ইসি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের এমন কার্যক্রমে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনাররা একটি পোস্ট অফিসের দায়িত্ব পালন করছেন। তারা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ও ফলাফলের গেজেট প্রকাশ নিয়ে আছে।

নির্বাচনে খুন-খারাবি, মারামারি বা নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ আছে কি না, এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে দেখছি না। অথচ বক্তৃতা করে সম্মানি নিতে দেখছি। তিনি বলেন, এখন যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে, সেটা কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনের সংজ্ঞায় পড়ে না।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা জানান, তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফল সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশের আগপর্যন্ত সময়কে ‘নির্বাচনি-পূর্ব সময়’ হিসাবে গণ্য করা হয়। এ সময়ে যে কোনো সহিংসতা, বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শনসহ অন্যান্য ঘটনা তদন্ত, কারও প্রার্থিতা বাতিল বা পুরো নির্বাচনই বাতিল করার এখতিয়ার নির্বাচনি আইনে রয়েছে। কিন্তু ফলাফল সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। গেজেট প্রকাশের বিষয়টি নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের অধীন চলে যাবে।

সহিংসতার তদন্ত করা নির্বাচন কমিশনের কাজ নয় বলে মন্তব্য করেছেন ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কোথায় মারামারি হলো সেটা দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।

এটা তাদেরই কাজ। আইনে নির্বাচন কমিশনকে তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া আছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনে বলা আছে, যদি প্রতীয়মান হয় নির্বাচনে অনিয়ম ও ব্যাপক সহিংসতার কারণে ফলাফল হেরফের হচ্ছে, সেটা দেখার দায়িত্ব ইসির। এখন যা হচ্ছে সেগুলো খণ্ডচিত্র, সার্বিক চিত্র নয়।

স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) নির্বাচন বিধিমালা, ২০১০-এর ৯১(ঘ) ধারায় বলা হয়েছে, আইন ও এই বিধিমালার বিধান অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রের নির্বাচন নিরপেক্ষ, ন্যায়সংগত, ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাবলি জারি, ক্ষমতা প্রয়োগ এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য আদেশ দিতে পারবে।

জানা গেছে, গত শনিবার অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপে সিরাজগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে দুপক্ষের সংঘর্ষে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিজয়ী কাউন্সিলর তারিকুল ইসলাম খান খুন হন। খুন হওয়া কাউন্সিলরের নাম বাদ দিয়ে বিজয়ী বাকি কাউন্সিলর ও মেয়র প্রার্থীর নাম সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন।

গেজেট প্রকাশের কারণ সম্পর্কে ইসি জানিয়েছে, এ নির্বাচনের ফলাফল স্থগিতের মতো কোনো অভিযোগ নেই। কোনো বিষয় তদন্তাধীন নেই এবং কোনো মামলাও নেই। এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আবুল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সংঘর্ষের বিষয়ে তদন্ত করতে নির্বাচন কমিশন থেকে কোনো নির্দেশনা পাইনি। বিষয়টি পুলিশ দেখভাল করছে।

আরও জানা গেছে, ঝিনাইদহের শৈলকূপা পৌরসভা নির্বাচনে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে গত বুধবার সহিংসতায় এক প্রার্থীর ভাই খুন হন। ওই ঘটনার পাঁচ ঘণ্টা পর আরেক কাউন্সিলর প্রার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১৬ জানুয়ারি শনিবার ভোটের দিন দুই মেয়র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

অথচ এ পৌরসভার ফলাফলের গেজেট প্রকাশ প্রক্রিয়াধীন। একইভাবে কুষ্টিয়ায় পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই কাউন্সিলর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে সোহেল সরকার (৫০) নামের একজনের মৃত্যু হয়।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও সহিংসতায় একজনের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনায় কোনো তদন্ত করেনি ইসি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সহিংসতায় একজনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বাড়ানো ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কমিশন। আগামী ২৭ জানুয়ারি এ সিটি করপোরেশনের ভোট হবে।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি পৌরসভা নির্বাচনে সহিংসতার তথ্য নির্বাচনকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। ওইসব পৌরসভার সহিংসতা ও অনিয়ম তদন্তে কোনো কমিটি গঠন করেনি ইসি। গাইবান্ধা পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন অফিসার মো. আব্দুল মোত্তালিব এক প্রতিবেদনে ইসি সচিবালয়কে জানিয়েছেন, ১৬টি ভোটকেন্দ্রের ভোট গণনার বিবরণী পাওয়ার পর আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জানায় ৩০নং জাগো ফাউন্ডেশন অনলাইন স্কুল ভোটকেন্দ্রের বাইরে জনতা উত্তেজিত হয়।

উচ্ছৃখল জনতা চারটি গাড়ি ভাঙচুর করে। ওই ঘটনায় জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। পরে ফল ঘোষণা করা হয়। ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌরসভার একটি কেন্দ্রে অপ্রীতিকর ঘটনায় ভোটগ্রহণ বন্ধের বিষয়টি ইসিকে জানায় ফরিদপুরের সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। দ্বিতীয় ধাপে এ দুটি পৌরসভায় ভোট হয়। এসব পৌরসভা নির্বাচনের ঘটনাও তদন্ত করছে না ইসি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/385669