১৯ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৩২

গ্যাসের সরবরাহ কমছে

# খোলাবাজার’ থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ
# দেশের ক্ষেত্রগুলোতেও উত্তোলন কম

দেশে গ্যাসের সরবরাহ ক্রমাগত কমছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খোলা বাজার (স্পট মার্কেট) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) কেনা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে জাতীয় গ্রিডে আমদানি করা এলএনজির দৈনিক সরবরাহ ৪০ কোটি ঘনফুটের নীচে নেমে এসেছে। পাশাপাশি দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকেও উত্তোলন কমেছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খোলা বাজার থেকে এলএনজি কেনার টেকসই পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদভাবে অবহিত না হয়েই গত সেপ্টেম্বর মাসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে দৈনিক ৪৫ থেকে ৫৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সমপরিমান এলএনজি খোলা বাজার থেকে কেনা হবে। অক্টোবর-নবেম্বরে দুইবার ওই পরিমাণ এলএনজি কেনাও হয়। তাতে প্রায় ৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছিল।

কিন্তু তারপরই আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজিসহ সব জ্বালানির দাম বাড়তে শুরু করে। এখন প্রতি ইউনিট (এক হাজার মিলিয়ন বা এক কোটি ঘনফুট) এলএনজির দাম উঠেছে ১২ মার্কিন ডলারে যা অক্টোবরে ছিল ৬ ডলারের কম। এই অবস্থায় খোলা বাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জাতীয় গ্রিডে এলএনজির সরবরাহ কমতে থাকে।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ নবেম্বর জাতীয় গ্রিডে আমদানি করা এলএনজি থেকে গ্যাসের সরবরাহ ছিল ৫৩ কোটি ১২ লাখ ঘনফুট। ১লা ডিসেম্বর ছিল ৪৯ কোটি ৪৭ লাখ। ১৫ ডিসেম্বর ছিল ৪৬ কোটি ১০ লাখ। ২৬ ডিসেম্বর ছিল ৩৯ কোটি ৬৯ লাখ। গত ৫-৬ জানুয়ারি তা আরও কমে হয়েছে ৩৯ কোটি ২৭ লাখ ঘনফুট।

অন্যদিকে, দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকেও গত মাস দুয়েক গ্যাস উত্তোলন কমেছে। তিনটি দেশীয় কোম্পানির (বিজিএফসিএল, এসজিএফএল ও বাপেক্স) পরিচালনাধীন ক্ষেত্রগুলোতে চালু কূপের সংখ্যা মোট ৭০টি। এগুলোর মোট উত্তোলন ক্ষমতা দৈনিক ১১৪ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট। নভেম্বরের মধ্যভাগ থেকে গড় উত্তোলন হচ্ছে ৮৫ কোটি ঘনফুটেরও কম। গত ৫-৬ই জানুয়ারি এই ৭০টি কূপে গ্যাস উত্তোলন হয়েছে গড়ে ৮৪ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট।

বিদেশি কোম্পানি শেভরন ও টাল্লো পরিচালনাধীন চারটি ক্ষেত্রে চালু কূপের সংখ্যা মোট ৪৩টি। এগুলোর মোট উত্তোলন ক্ষমতা দৈনিক ১৬১ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট। গড় উত্তোলন প্রায় ১৬৫ কোটি ঘনফুট।

পেট্রোবাংলার এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মূলতঃ দেশীয় কোম্পানির ক্ষেত্রগুলো থেকে উত্তোলন কম এবং এলএনজির সরবরাহ স্বল্পতাই গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণ।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, দাম বৃদ্ধি এবং খোলা বাজার থেকে কেনার ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞতার কারণে এলএনজির সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। এটা স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে সাধ্যমত উত্তোলন বাড়িয়ে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেশি সময় চালানোরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে গ্যাসের সরবরাহ স্বল্পতার কারণে অন্ততঃ ২৫টি ছোট-বড় এবং সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এই বন্ধ কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় তিন হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। শীতের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কম থাকায় তেলচালিত কেন্দ্রগুলো বেশি চালিয়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে বলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সূত্র জানিয়েছে।

পাইপলাইনের সমস্যার কারণে চট্টগ্রামে এলএনজি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে বন্দর নগরীর পাশাপাশি রাজধানীতেও গ্যাস সংকট বাড়ছে। উত্তরা, আজিমপুর, পান্থপথ, রামপুরা, বনশ্রী, মিরপুরসহ পুরনো ঢাকায় দিনের বেলা গ্যাসের চাপ এত কম যে রান্নাই করা যাচ্ছে না।
জ্বালানি বিভাগের এক কমকর্তা জানান, পাইপলাইনের সমস্যার কারণে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে চট্টগ্রামে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সেই ঘাটতি মেটাতে জাতীয় গ্রিডেও গ্যাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এছাড়া শীত শীত আবহাওয়ায় গ্যাসের চাহিদাও বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে শুধু আবাসিক নয়, ঘাটতি পড়েছে শিল্প, বিদ্যুৎ ও সার কারখানায়। পিডিবি জানায়, বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ কিছুটা কমেছে। তবে এখনও সরবরাহ সাভাবিক আছে।

তিতাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার শিল্প কারখানায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে। তবে বেশি সমস্যা হচ্ছে ঢাকায় বাসাবাড়িতে।

আজিমপুরের বাসিন্দা তাসনিমা বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরেই সকাল ১০টার পর গ্যাসের চাপ এত কমে যায় যে রান্না করা যায় না। বিকাল ৪টার পর গ্যাস সরবরাহ ঠিক হয়।’

বনশ্রী ই ব্লকের বাসিন্দা মারিয়া হক বলেন, ‘আগে থেকেই সমস্যা ছিল। গত দুই তিন দিন ধরে দিনের বেলা গ্যাসই থাকছেই না।’
উত্তরা থেকে আয়শা সুলতানা বলেন, শনিবার সকাল থেকেই গ্যাসের চাপ এত কম যে চায়ের পানিও গরম করতে পারিনি। দুপুরে রান্না করা যাচ্ছে না। বিকালের দিকে সব রান্না সারতে হচ্ছে।’

তিতাস গ্যাস একজন কর্মকর্তার বলেন, ‘এলএনজির কারণে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে তা খুব বেশি নয়। আমরা সরবরাহ সাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। আমরা বিদ্যুতে সরবরাহ কমিয়ে অন্যগুলাতে সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করছি। বিদ্যুতে দু’ধরনের জ্বালানি দিয়ে (ডুয়েল ফুয়েল) যেসব কেন্দ্র চলে সেগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছি । তিতাসের মোট ১৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধে ১০টি কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে।’

 

https://dailysangram.com/post/441043