১৬ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১১:৫৪

ইন্টারনেট তাল-বেতাল বেহাল শিক্ষাব্যবস্থা

ইন্টারনেট সেবার মানের ক্রমশ অবনতির কারণে বেহাল অবস্থায় পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস ব্যাহত হচ্ছে ইন্টারনেটের ধীরগতির কারণে। ইন্টারনেটভিত্তিক অন্যান্য সেবাও বাধাগ্রস্ত। দেশে দুটি সাবমেরিন কেবল এবং একটি স্যাটেলাইট পর্যাপ্ত ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ সরবরাহের সক্ষমতা অর্জন করলেও গ্রাহক পর্যায়ে তার সুফল পৌঁছাচ্ছে না।

করোনাভাইরাসের কারণে এখন অনেক কিছুই ইন্টারনেট বা ডাটা সেবার ওপর নির্ভরশীল। ইন্টারনেটের চাহিদা মোবাইল অপারেটরদের বিভিন্ন ডাটা প্যাকেজ বিক্রি এবং সেই সঙ্গে আয়ও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেবার মান বৃদ্ধি না হয়ে ক্রমশ কমছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মোবাইল ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাটা কিনেও তারা প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। আবার নির্ধারিত মেয়াদে তা শেষও করতে পারছে না। ফলে এক ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছে তারা।

ঢাকার বাইরে অবস্থা আরো শোচনীয়। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও চাহিদা মেটাতে পারছে না। এ সংকটের সমাধান কিভাবে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তারও স্পষ্ট কোনো জবাব নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুতগতির ইন্টারনেট পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের সবই আছে। অপারেটর, বিনিয়োগকারী, ব্যান্ডউইথ—কোনো কিছুর অভাব নেই। কিন্তু এর উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য দক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগও ইন্টারনেট সেবার মানের অবনতির বিষয়টি অস্বীকার করছে না। এ বিভাগের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনা শুরু হওয়ার পর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও ইন্টারনেটের চাহিদা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। আগে মোবাইল ফোন অপারেটররা ইন্টারনেট সেবাকে ব্যবসা হিসেবে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। এ জন্য প্রয়োজনীয় স্পেকট্রামও সংগ্রহ করেনি তারা। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও গড়ে ওঠেনি। তবে এ বিষয়ে সম্প্রতি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফোরজি নেটওয়ার্ক বাড়ানো হচ্ছে। আশা করছি, আগামী ২৬ মার্চের আগেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর মূলত অনলাইন ক্লাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায় পড়ালেখা। তবে ইন্টারনেটের দুর্বল গতির কারণে নিয়মিত ক্লাস করাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরের শিক্ষার্থীরা কোনো রকম এই ক্লাস চালিয়ে নিতে পারলেও অন্যান্য জায়গায় তা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই শত চেষ্টা করেও ইন্টারনেটে যুক্ত হতে পারছে না। আবার অনেকের ক্লাস মাঝপথে কেটে যাচ্ছে। তবে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরই অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লাসই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার কোটির ওপরে। উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। আর উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪১ লাখ।

রাজধানীর একটি নামি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীর অভিভাবক জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আমার বাসা মিরপুর। গত ১০ জানুয়ারি থেকে আমার ছেলের অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। আমরা ব্রডব্যান্ড কানেকশন ব্যবহার করছি। কিন্তু কয়েক দিন ধরে ইন্টারনেট যথেষ্ট ঝামেলা করছে। ইন্টারনেটের ধীরগতির কারণে যথাসময়ে ক্লাসে যুক্ত হওয়া যাচ্ছে না, মাঝপথে লাইন কেটে যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহে একদিন তো ইন্টারনেট সমস্যার কারণে টিচার নিজেই ক্লাস নিতে পারেননি।’

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই দেশের বিভিন্ন এলাকার। নিজ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন এমন সংখ্যা হাতে গোনা। গত ১৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পর তাঁরা নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস চললেও সব শিক্ষার্থীর পক্ষে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ নেই। অনেকেই উচ্চদামের ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে পারছেন না। আবার মফস্বলের বেশির ভাগ জায়গায়ই ইন্টারনেট ভয়াবহভাবে দুর্বল। ফলে ডিভাইস থাকলেও শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছেন না। এতে শিক্ষায় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।

তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য টেলিভিশনে ক্লাস প্রচার হলেও সম্প্রতি ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই টেলিভিশন ক্লাসে অংশ নেয়নি। যারা অংশ নিচ্ছে না তাদের ৭১ শতাংশই বলছে, বাড়িতে টিভি, ডিস সংযোগ বা ইন্টারনেট নেই। ইন্টারনেটের ধীরগতির কারণেও ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।

ঢাকার বাইরের অবস্থা আরো শোচনীয়। পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার পাথরঘাটা গ্রামের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া তাবাসসুমের মা শম্পা সরকার বলেন, ‘দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর থেকে মেয়েকে নিজেই পড়ানো শুরু করি। স্কুলের অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করার জন্য বাসায় ওয়াইফাই সংযোগ নিই। জুম অ্যাপসের মাধ্যমে মেয়ে ক্লাসে অংশ নেয়। কিন্তু ইন্টারনেটের গতি কম থাকার কারণে ক্লাসের বেশির ভাগ সময় হ্যাং হয়ে থাকে। মোবাইল ইন্টারনেটের ডাটা প্যাকেজ কিনেও সমস্যার সমাধান হয় না। এখন বাধ্য হয়ে বাসায় প্রাইভেট শিক্ষক নিয়েছি। ইন্টারনেটের সমস্যা দূর না হলে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার তারাশী গ্রামের শিক্ষার্থী তাহমিদা নূর তিনার বাবা শফিকুল ইসলাম জানান, ইন্টারনেট গতিহীনতা বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্কুলে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে, কিন্তু সুফল মিলছে না।’

চুয়াডাঙ্গা কোর্টপাড়ার গৃহিণী মমতাজ আরা বলেন, ‘মেয়ে অদ্রিজা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। তাকে অনলাইনে প্রাইভেট পড়তে হয়। বাড়িতে আছে ওয়াইফাই সংযোগ। জুমের মাধ্যমে পড়তে হয় তাকে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই নেট থাকে না। থাকলেও গতি নেই।’

এ পরিস্থিতি সম্পর্কে আঞ্চলিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র রিসার্চ ফেলো আবু সাঈদ খান গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ সমস্যা সমাধানের জন্য উপযুক্ত মেধাসম্পন্ন এবং স্বাধীনভাবে কর্মক্ষম নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। দ্রুতগতির ইন্টারনেট পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের সবই আছে। অপারেটর, বিনিয়োগকারী, ব্যান্ডউইথ—কোনো কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু এর উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য দক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। অপারেটররা যদি নিম্নমানের সেবা দিয়ে পার পেয়ে যায়, তাহলে মানসম্মত সেবা কেন দেবে? গোয়ালা যদি পানি মিশিয়ে দুধ বিক্রিতে বাধা না পায়, তাহলে ওই কর্মই করে যাবে সে। নিয়ন্ত্রণহীন এ পরিস্থিতিতে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সুযোগ নিচ্ছে। ভোগান্তি শুধু গ্রাহকদের।’

ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসডিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার) চাহিদার তুলনায় কম ব্যান্ডউইথ কিনে থাকে। যেখানে এক হাজার জিবিপিএস ব্যান্ডউইথের চাহিদা, সেখানে হয়তো ৯০০ জিবিপিএস কিনছে। গ্রাহকরা বেশি দামে ইন্টারনেট সংযোগ নিতে চায় না বলে এই অবস্থা চলছে। এতে গ্রাহকরা কাঙ্ক্ষিত গতি না-ও পেতে পারেন। তবে বড় আইএসপিদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা নেই বলেই জানি। আর একটি সংকট হয় সাবমেরিন কেবল থেকে পাওয়া ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের গতি মাঝেমধ্যে কমে যাওয়ার কারণে। বিশেষ করে আগে সিঙ্গাপুর হয়ে আসা ব্যান্ডইউথ অতিরিক্ত কনজেশনের কারণে স্লথ হয়ে পড়লে এ সমস্যা দেখা দেয়। পশ্চিমে ইউরোপ হয়ে আসা ব্যান্ডইউথের ক্ষেত্রে এ সমস্যা কম। কিন্তু আমাদের চাহিদার ৭৫ শতাংশ ব্যান্ডউইথ সিঙ্গাপুর হয়েই আসে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রচুর ব্যান্ডউইথ পড়ে আছে। দেশে চাহিদা ২১০০ জিবিপিএসের কাছাকাছি। আমরা এ চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করতে সক্ষম। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১৪৫০ জিবিপিএস। বাকিটা আসছে ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) অপারেটরদের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ থেকে। সিঙ্গাপুর হয়ে আসা ব্যান্ডইউথে কোনো সমস্যা আমাদের সাবমেরিন কেবল থেকে হয় না।

মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অব.) গতকাল বলেন, মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে একজন ব্যবহারকারীর নানা রকম অভিজ্ঞতা বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন রকম হতে পারে। উঁচু ভবন, দুর্বল সিগন্যাল, অননুমোদিত জ্যামার থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনের মানের ওপরও তা নির্ভর করতে পারে। তবে গত দুই বছরে টাওয়ার কম্পানির টাওয়ার স্থাপন না হওয়ায় নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করতে না পারা এবং অতিরিক্ত মূল্যের কারণে স্পেকট্রামের দুষ্প্রাপ্যতা এর বড় কারণ। তা ছাড়া করোনাকালে হঠাৎ করে ডেটা ব্যবহারে চাপ বেড়ে গেছে। তবে সাম্প্রতিক কিছু জরিপ অনুযায়ী দেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী মোবাইল ইন্টারনেটের কারণেই ঘরে বসে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সেবাদাতারা তাদের গ্রাহকদের সর্বোত্তম সেবাটাই নিশ্চিত করার চেষ্টা করে এবং তা নিশ্চিত করতে নিয়মিতই বিনিয়োগ করে যাচ্ছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/01/16/995450