১৬ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১১:৫৩

মশায় অতিষ্ঠ নগরজীবন

দিনেও মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হয়

আগামী সপ্তাহে দুই সিটিসহ ডেঙ্গুবিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হবে

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের দেশে যত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন তার দুই- তৃতীয়াংশ মারা গেছেন রাজধানী ঢাকা শহরে। আক্রান্ত তালিকার মধ্যে বেশির ভাগই ঢাকা মহানগরীর মানুষ। করোনার মধ্যে যাতে ডেঙ্গু রোগের পাদুর্ভাব না ঘটে সে লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞরা ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিল। ২০২০ সালের ৩১ মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনেও ‘মশা গান শোনাচ্ছে’ মন্তব্য করে ঢাকার মেয়রদের সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। মশা মারতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে গড়িমসিতে রাজধানীতে মশার উপদ্রব বেড়েছে। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ বিভিন্ন মহানগরীর এলাকার বাসিন্দারা।

রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইদানীং মশার উপদ্রব ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নর্দমা, খাল এবং ময়লা-আবর্জনা ভালোভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না হওয়ায় মশা বেড়ে গেছে। রাজধানীর বাসিন্দারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী মেয়রদের বলার পর মাঝখানে কয়েক মাস মশা ছিল না বললেই চলে। তখন ঢাকা উত্তরের মেয়র ওয়ার্ডগুলোকে ১০ অঞ্চলে ভাগ করে মশা মারার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বাসায় বাসায় ঘুরে এডিস মশার লার্ভার খোঁজ করে বাড়ির মালিকদের সতর্ক করেছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাড়ির মালিকদের জরিমানা করা হয়েছে।

সীমিত পরিসরে হলেও ঢাকা দক্ষিণেও মশা মারতে স্প্রে করা হয়েছে। কিন্তু এ সময় সেগুলো কার্যত টিভি ক্যামেরানির্ভর হয়ে যায়। ফলে এখন আবার মশার কামড়ে জীবন অতিষ্ঠ। মশা এত বেশি বেড়েছে যে, দলবেঁধে কামড়ায়। বাসার নিচতলা থেকে ১০তলা পর্যন্ত মশা হানা দেয়। সন্ধ্যার সময় নর্দমা ও ময়লার ভাগাড়গুলোতে দেখা যায় কোটি কোটি মশা ভন ভন করে উড়ছে।

মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নাগরিকরা ক্ষাভ প্রকাশ করে বলছেন, গত বছরের মার্চে মশার উপদ্রব যখন চরম আকার ধারণ করেছিলে তখন মশা নিয়ন্ত্রণ করতে প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হয়েছিল। তারপর কয়েক মাস মশা একেবারে ছিল না বললেই চলে। এখন আবার বেশ কয়েক সপ্তাহ থেকে মশার উপদ্রব চরম আকার ধারণ করেছে। এমন কী হলো যে, এখন আবার এত মশা। তার মানে সংশ্লিষ্টরা ঠিকমতো কাজ করছে না কিংবা ভালো ওষুধ ছিটাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীকেই কেন বলে বলে কাজ করাতে হবে?

রাজধানীতে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গত ১২ জানুয়ারি সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, মশা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে কি না আমি জানি না। তবে ইদানীং কিছু কিছু মশা দেখা যাচ্ছে। আমার নিজের বাসাতেও মাঝে মধ্যে দু-একটা মশা দেখি। যেটা কিছুদিন দেখিনি।

রাজধানীর গুলশান, বারীধারা ও বনানীকে অভিজাত এলাকা হিসেবে ধরা হয়। সিটি কর্পোরেশন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সব কার্যক্রম ওই অভিজাত এলাকা থেকেই শুরু হয়ে থাকে। কিন্তু বনানী ও গুলশানের বাসিন্দারা জানান, সেখানে মশার উপদ্রব ব্যাপক বেড়েছে। গুলশানের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, মশার যন্ত্রণায় তারা অতিষ্ঠ। ঝাঁক বেঁধে মশা কামড়ায়, থাপ্পড় দিলে একসঙ্গে অনেকগুলো মশা পড়ে। আর এখানকার মশাগুলো আকারে বেশ বড়।

বাড্ডার একাধিক বাসিন্দা জানালেন, এখানে এমনও এলাকা রয়েছে দিনে মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমাতে হয়। একই তথ্য দিয়েছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের অনেকেই। গুলিস্তানের হকার্স সুমন মোদক বলেন, মেসে থাকি। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। রাতে এবং দিনে মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমাতে হয়।

রাজধানীর উত্তরা, বসুন্ধরা এলাকাও মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন মানুষ। আল মামুন নামে এক ফল বিক্রেতা বলেন, উত্তরার পথঘাটের কোথাও দাঁড়াতে পারি না মশার কারণে। হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে মশা এমনভাবে কামড়য় যেন মনে হয় শরীরে পিঁপড়া কামড়াচ্ছে। মশার জ্বালায় টেকা যায় না।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, মালিবাগ, রামপুরা, মতিঝিল, পল্টন, আজিমপুর ও মিরপুরের বাসিন্দারা জানান, এসব এলাকায় মশার উপদ্রব মারাত্মকভাবে বেড়েছে। সন্ধ্যা হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে মশা হানা দেয়। যাত্রাবাড়ী রসুলপুরের বাসিন্দা আব্দুল কাদের ও শনির আখড়ার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান মিজান বলেন, মশা এত বেশি যে, মনে হয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ২/১ মিনিট চুপ করে বসলেই মশা ঝাঁক বেঁধে কামড়াতে শুরু করে। মাঝে মাঝে শুনি মশা মারতে স্প্রে করা হচ্ছে। সেগুলো ধোঁয়া বিতরণ নাকি মশা মারার ওষুধ বোঝার উপায় নেই।

জুরাইন, কদমতলী, শ্যামপুর এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব এলাকাতেও মশার উপদ্রব বেড়েছে। এই এলাকার বাসিন্দারা বলেন, জুরাইন, কদমতলী, শ্যামপুর এলাকায় মশার উপদ্রব অনেক বেশি। সন্ধ্যা হলে বাইরে থাকা তো দূরের কথা ঘরে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ে। কানের কাছে গান গায়। ৫২ ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না এবং ওষুধ ঠিকমতো কাজ করছে না।

মহানগরীর মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে আগামী সপ্তাহে সিটি কর্পোরেশনসহ ডেঙ্গুবিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, শীতের মৌসুমে ঋতুগত কারণে মশা বেড়েছে। কারণ এডিস যেমন পরিষ্কার জমা পানিতে হয় তেমনি কিউলেক্স মশা নোংরা, অপরিষ্কার পানিতে হয়। শীতকালে এখন যে মশা সেটি ম‚লত কিউলেক্স মশা। অনেক নর্দমা শীতকালে শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে কিউলেক্স মশা জমছে। আবার বর্ষাকালে খাল-নর্দমায় পানি যেমন বহমান থাকে শীতকালে কিন্তু তেমন না। তাই মশা বেড়েছে।

তিনি আরো বলেন, আমরা ওয়াসা থেকে খালগুলো বুঝে পেয়েছি। এগুলো আমরা পরিষ্কার করছি। এসব খাল থেকে কচুরিপানা পরিষ্কার করা হচ্ছে। এসব খাল ও কচুরিপানায় যেসব মশা থাকত তার একটি অংশ কিন্তু উড়ে লোকালয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০টি ‘মিক্সড বেøায়ার’ কেনার প্রক্রিয়া চ‚ড়ান্ত হয়েছে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এগুলো আমরা হাতে পাব। ১০টি অঞ্চলে ১০টি মিক্সড বেøায়ার দিয়ে ওষুধ ছিটানো শুরু হলে মশা কমে যোবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/350527