১৬ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১১:৪৯

বিপর্যস্ত গার্মেন্ট

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের নেতিবাচক প্রভাব

বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে এসেছে : মোহাম্মদ হাতেম
প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে : ড. আহসান এইচ মনসুর
আগস্টের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা
নেই : আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ
অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায় আমরা বিপর্যস্ত : ড. রুবানা হক

করোনা মহামারির প্রথ ধাক্কা সরকারি প্রণোদনা সুবিধার বদৌলতে কোনভাবে কাটিয়ে উঠতে পারলেও চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। নতুন কোনো রফতানি আদেশ না আসায় কর্মহীন পড়ে আছে পোশাক প্রস্তুতকারক যন্ত্রপাতিগুলো। এই পরিস্থিতিতে নতুন চাপ হয়ে দেখা দিয়েছে ঋণের কিস্তি। করোনার প্রথম ধাক্কা সামলাতে সরকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় যে ঋণ দিয়েছিল তার কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে চলতি মাস থেকে। তবে অধিকাংশ গার্মেন্ট কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন গার্মেন্ট মালিকরা। আর কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিনের মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়বেন অনেক ব্যবসায়ী। এই খেলাপির অভিঘাতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি চাপে পড়বে ব্যাংকগুলোও। কারণ খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এতে ব্যাংকগুলো লোকসানে চলে যেতে পারে। কারণ মুনাফা থেকেই প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার এপ্রিল পর্যন্ত নিম্নমুখী থাকতে পারে। কারণ ইউরোপ-অ্যামেরিকায় এখনও সবার ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি এবং তাদের অর্থনীতিতেও স্থবিরতা কাটেনি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী কয়েক মাসে রফতানিতে আঘাত লাগার আশঙ্কা বেশি। কারণ, দেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির অবনতি না হলেও ইউরোপজুড়ে এখনও করোনার তান্ডব চলছে। এর আঘাত যদি রফতানি খাতে লাগে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো দেশের অর্থনীতি।
সূত্র মতে, বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে, ফলে এই শিল্প দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত।

দেশে করোনা প্রকোপের শুরুর দিকে বিজিএমইএ জানিয়েছিল, করোনার কারণে প্রায় ৩২৫ কোটি ডলরের রফতানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। এসব কারণে কম পুঁজির অনেক কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধও হয়ে গেছে। আর বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামীতে আরো বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ ও এশিয়া অঞ্চলে যখন করোনার সংক্রমণ শুরু হয়, তার পরের মাসেই দেশের পোশাক খাত মুখ থুবড়ে পড়ে। গড় রফতানি দুই-তৃতীয়াংশ কমে এক বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। বেতন বকেয়া, আকস্মিক ছাঁটাই ও কর্মহীনতার মুখে পড়ে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জের শ্রমঘন এলাকায় শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন চালিয়েছিল পোশাক শিল্প মালিকরা। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রফতানি বাড়ায় তারা আশাবাদী হলেও নতুন বছরের শুরুতে নেমে এসেছে হতাশা।

গার্মেন্ট মালিকরা বলছেন, পোশাকের বৈশ্বিক বিক্রির পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধারের কোনো ইঙ্গিত নেই। পশ্চিমের অনেক দেশ এখনো লকডাউন। তারা অর্থনীতি পুনরায় সচল হওয়া নিয়ে লড়াই করছে। এতোদিন যেসব পণ্য রফতানি হয়েছে, সেগুলো আগের অর্ডারের। নতুন করে ক্রেতারা অর্ডার দিচ্ছে না। আর দিলেও আগের তুলনায় ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে কী হবে তা আন্দাজ করা মুশকিল বলে উল্লেখ করেন একাধিক গার্মেন্টস মালিক।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ইউরোপজুড়ে যে তান্ডব চলছে, তাতে রফতানিতে ধাক্কা লাগতে পারে। এরইমধ্যে রফতানি শ্লথ হয়ে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে।

এদিকে করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাতে তৈরি পোশাক রফতানি কমে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের’ জানুয়ারি সংখ্যায় এই ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

করোনা মহামারিকালে বিদায়ী বছরের শেষ মাসে পণ্য রফতানি থেকে ৩৩১ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ কম।

এই পরিস্থিতিতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীর এই খাতে নতুন করে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ইনকিলাবকে বলেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে এসেছে। কয়েকদনি জার্মানি লকডাউন দিয়েছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অনেক দেশ লকডাউন দিয়েছে। আগামী কয়েক মাসের জন্য যে অর্ডার আসার কথা ছিল তা পুরোপুরি বন্ধ আছে। নতুন আদেশ নেই বললেই চলে। এমনকি অনেক রেডি অর্ডারের মালও নিচ্ছেনা। আগামী এপ্রিল পর্যন্ত পরিস্থিতি খারাপ যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায় আমরা বিপর্যস্ত। করোনার টিকার প্রাপ্যতা এখনও নিশ্চিত হয়নি। আমাদের শঙ্কা, পোশাক রফতানির নিম্নমুখী প্রবণতা আগামী এপ্রিল পর্যন্ত থাকতে পারে।

তিনি বলেন, মহামারীর ধাক্কা থেকে শিল্প রক্ষায় সরকার পোশাক কারখানা মালিকদের স্বল্প সুদের যে ঋণ দিয়েছিল, তা পরিশোধে ছাড় চেয়ে ইতোমধ্যে একটি খোলা চিঠি দেয়া হয়েছে। শ্রমিকের বেতন বাবদ সরকার পোশাক খাতকে যে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ দিয়েছিল; আট মাসের গ্রেড পিরিয়ড শেষে জানুয়ারি থেকেই তা পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা। চিঠিতে সেই টাকা পরিশোধের সময় আরও ছয় মাস বাড়ানো অথবা প্রণোদনা পরিশোধের মেয়াদ আরও অতিরিক্ত ১ বছর স¤প্রসারিত করার দাবি জানানো হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ি বলেন, আগামীতে আগের মতো অর্ডার আসলেও সমস্যাটা হবে প্রণোদনার ঋণ পরিশোধ নিয়ে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি ঋণ পরিশোধ করতে হয়, তাহলে অধিকাংশ কারখানা অচল হয়ে পড়বে। কারণ ফুলস্কেলে গেলে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লাগবে, সেটা থেকে যদি তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়, তাহলে সেটা তার জন্য যথেষ্ট হবে না।

এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রফতানি থেকে আয় হয়েছে এক হাজার ৫৫৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তিন শতাংশ কম।

এদিকে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ আগামি আগস্টের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা দেখছেন না। আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ মনে করেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা আগের চেয়েও বেশি উদ্বেগের। তিনি বলেন, ইউকে, জার্মান, ফ্রান্সের অবস্থা খারাপ। আমেরিকার অবস্থাও ভাল না। আমাদের যেহেতু ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের জিনিসপত্র, বড়দিনের বিক্রিও খারাপ হয়েছে। বিক্রি বন্ধ করে দিতে হয়েছে ওদের। প্রথম ঢেউয়ে কিন্তু এতটা ছিল না, এখন অবস্থা খুবই খারাপ। সবাই টার্গেট করেছিল, ক্রিসমাসে ক্ষতিটা পুষিয়ে উঠবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। বিসিআই সভাপতি বলেন, নিটে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অর্ডার আসছে। আর উভেন সেক্টরে সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের মতো অর্ডার আসছে।

উল্লেখ্য, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর রফতানিতে ধস নামায় পোশাক খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের ছয় মাসের (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য স্বল্প সুদে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয় সরকার। চলতি জানুয়ারি মাস থেকে ওই ঋণ পরিশোধে ২৪ মাসের কিস্তি শুরু হওয়ার কথা। স¤প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক চিঠিতে জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ঋণ পরিশোধ শুরু করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। #

https://www.dailyinqilab.com/article/350543