১৬ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার, ১১:৪৪

সংশ্লিষ্টরা একে অন্যকে দুষছে

অনিয়মে অনিশ্চিত কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ প্রকল্প

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সীমাহীন দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ * গণপূর্ত, স্বাস্থ্য ও সংস্থাপন বিভাগের অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছতা রয়েছে

মুখ থুবড়ে পড়েছে নির্মাণাধীন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি, সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত, স্বাস্থ্য ও সংস্থাপন বিভাগের অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছতার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।


তবে সংশ্লিষ্টরা একে অপরকে দুষছেন। কাজের মেয়াদে দীর্ঘসূত্রতায় প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। নির্মাণ পদ্ধতি লঙ্ঘন করায় ছাদ ধসে শ্রমিকের মৃত্যু। সবকিছু মিলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প সম্পন্ন হওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

জানা গেছে, মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমোদন চেয়ে একনেক সভায় উপস্থাপিত উন্নয়ন প্রস্তাবনায় ক্ষুব্ধ একনেক সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। স্বপ্নের মেডিকেল কলেজ নিয়ে হতাশ জেলাবাসী। জেলার সচেতন নাগরিকদের দাবি, রাজনৈতিক প্রভাবের লেবাসে সরকারের উন্নয়ন সফলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে অনিয়ম-দুর্নীতির হোতারা।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়াসহ আশপাশের পাঁচ জেলার মানুষের চাহিদা মাথায় রেখে একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন, দরবৃদ্ধি করে কার্যাদেশ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের সত্যতা উঠে আসে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প ‘বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ’ (আইএমইডি) পরিদর্শনের পর দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে।

সেখানে প্রকল্পটির নির্মাণাধীন একাডেমিক, হাসপাতাল, ছাত্রাবাস ও আবাসিকসহ সবক’টি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই নকশা পরিবর্তনসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে প্রকল্পটির প্রায় সব ক্ষেত্রেই বেঁধে দেওয়া ব্যয়ের সীমা লঙ্ঘন করে অনুমোদন না নিয়েই অর্থ ব্যয় করে সরকারি ক্রয় আইনের ‘গুরুতর লঙ্ঘন’ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

নির্মাণাধীন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সাততলা হাসপাতাল ভবনের চতুর্থ থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি টাকা নির্মাণ চুক্তিতে কাজ করছেন বিশ্বাস ট্রেডিং কনস্ট্রাকশন। সংশ্লিষ্ট এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাইট ইঞ্জিনিয়ার সিবেশ্বর মালো বলেন, আমরা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারব না, কারণ সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত বিভাগের ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সময়মতো ড্রয়িং, ডিজাইনসহ আনুষঙ্গিক নির্দেশনা দিতে অধিকাংশ সময়ই বিলম্ব করেন, এতে কাজের গতিও অনেকটা ঝুলে যায় এবং বারবার প্রকল্প রিভাইজের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। উনারাই বলতে পারবেন কেন এমন হচ্ছে?

নির্ধারিত নকশা পরিবর্তন, নির্মাণ পদ্ধতি লঙ্ঘন করে সঠিক উপকরণ ব্যবহার না করায় ছাদ ধসে শ্রমিকের মৃত্যু, বারবার দর বাড়িয়ে কার্যাদেশ আদায়সহ নানা অনিয়মে অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টি ই এ এল-জহিরুল লিমিটেড প্রকল্প দুর্ঘটনার দায়ে কালো তালিকাভুক্ত হয়। অথচ এখনও বহাল আছে সেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত সাইট ইঞ্জিনিয়ার সবুজ বলেন, আমরা ১ লাখ ৪০ হাজার বর্গফুটের মূল হাসপাতাল ভবনের প্রথম থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ অনেক আগেই শেষ করেছি। এখন ওইসব ফ্লোরগুলোতে নির্ধারিত অবকাঠামোর দেয়াল নির্মাণসহ প্লাস্টারের কাজ চলছে। এ কাজটি এখনও অনুমোদন হয়নি।

চলমান কাজ কেন অনুমোদন পায়নি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘এসব কিছু আমি বলতে পারব না, আমার ঠিকাদার জহুরুল সাহেব এবং গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।’

প্রকল্পে অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতার সব অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম গণমাধ্যমে সামনে কোনো রকম মুখ খোলেননি। তিনি নিরুপায় মন্তব্য করে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট তিনটি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ওপর দায় চাপান।

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন কুষ্টিয়ার সহ-সভাপতি কারশেদ আলম বলেন, ২০১২ সালের ৩ মার্চ একনেক সভায় ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করে। প্রকল্পটির নির্ধারিত নির্মাণকাল ৩ বছর থাকলেও ৯ বছর পরও তা শেষ হয়নি। ইতোমধ্যে তৃতীয় বারের মতো সময় ও ব্যয় সম্প্রসারণ অনুমোদন পায়।

প্রকল্প ব্যয় এখন প্রায় ৭শ’ কোটি টাকা, এতেও কাটছে না প্রকল্প সম্পন্নের অনিশ্চিত অন্ধকার। এতবড় একটি প্রকল্প সাইটে কাজ চলছে অথচ প্রকল্প সারসংক্ষেপ সংবলিত কোনো প্রজেক্ট বোর্ড না থাকাটাও অস্বচ্ছতার একটা প্রমাণ। বর্তমান সরকার কুষ্টিয়া জেলায় ছোট-বড় নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবের লেবাসে সব উন্নয়ন সফলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে অনিয়ম-দুর্নীতির হোতারা।

কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, কুষ্টিয়াবাসীর স্বপ্নের মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্পটি যাদের কারণে বারবার এমন অনিশ্চতায় হোঁচট খাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সেই সঙ্গে অবিলম্বে এ প্রকল্পটির নির্মাণ সম্পন্ন করে সীমাহীন কষ্টে থাকা শিক্ষার্থীদের আপন ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেয়ার আবেদন জানাচ্ছি।

কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. সরোয়ার জাহান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আশ্বাসের বাণী শুনে কেটে গেছে ৯টি বছর। এখন আমাদের নবম ব্যাচ চলছে। ইতোমধ্যে চারটি ব্যাচ এখান থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য সেবায় যোগদান করেছেন। জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকম চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষাদান করতে শিক্ষক এবং শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীরা নানাবিধ সমস্যার মধ্যে আছে। অস্বাস্থ্যকর, পরিত্যক্ত ও জরাজীর্ণ আবাসনের সংকটে থাকা শিক্ষার্থীরা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ জীবন-যাপন করছে একই ভাবে তাদের শিক্ষাদানসহ একাডেমিক কার্যক্রমে প্রাসঙ্গিক আয়োজন সংকুলান করতে পারছি না। বিদ্যমান পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান দাবি জানান তিনি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/384289