১৫ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ৭:৩২

‘নান্টু দা আরও বড় চোর’

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : যারা গান শোনেন, তাদের মধ্যে এমন কেউ সম্ভবত নেই যিনি নচিকেতা চক্রবর্তীর ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটি শোনেননি। সে গান শুনে চোখ ভারী হয়ে আসে না- এমন লোকও বোধ করি কমই আছেন। বিশাল বাড়ি, বড় চাকরি, টাকা পয়সা সবকিছু থাকা সত্ত্বেও ছেলে তার মাকে পাঠিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। ঐ গানে সেখানে একজন মায়ের হাহাকার ফুটে উঠেছে। তিনি জানেন, তার ছেলেকেও চাকরি থেকে অবসরের পর এই বৃদ্ধাশ্রমে উঠতে হবে। এখন মা আর ছেলে বৃদ্ধাশ্রমে থাকবেন পাশাপাশি। ছেলে অনুভব করতে পারবে বৃদ্ধাশ্রমের যাতনা। ঐ গানের ভেতর দিয়ে মা স্মরণ করেছেন কীভাবে কী পরম স্নেহে আদরে ছেলেকে তিনি বড় করে তুলেছেন। সেই ছেলের কাছে মা-ই বাড়তি হয়ে গেল সংসারে। এমনি সব জীবন ঘনিষ্ঠ গান লিখেছেন ও গেয়েছেন নচিকেতা। 

তার আর একটি গান ‘মুখ্যু সুখ্যু মানুষ আমি কিছুই বুঝি না’। সেখানে আছে ভোটের গল্প। কর্পোরেশন নির্বাচন হয়ে গেছে। দেখেন এক লোক নাচছে, তার চেনা। নচিকেতা জিজ্ঞেস করলেন, এই তুই নাচছিস কেন? লোকটি সুর করে বলল, ‘নান্টু দা জিতে গেছে’। তা কী হয়েছে? পল্টু দা হেড়ে গেছে। তা তোর কি? পল্টু দা চোর ছিল। আর নান্টু দা? ‘নান্টু দা তার চেয়েও বড় চোর’। তা তুই নাচছিস কেন? এই নাচছি আর কি। নান্টু দা জিতে গেছে। অর্থাৎ আমাদের দেশগুলোতে ছোট ছোট চোরেরা কখনও কখনও হেরে যায়। কিন্তু যে জেতে সে হয় তার চেয়েও বড় চোর।

না, আমি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ও বর্তমান মেয়রকে চোর বলছি না। তারা পরস্পরকে বলছেন। এ ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছিল জালিয়াতির ভোটে ফজলে নূর তাপসের মেয়র হওয়ার পর থেকে। মেয়র পদে তার আগে ছিলেন মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকন। এটা খোকনের প্রথম টার্ম ছিল। সঙ্গত কারণেই তিনি আশা করেছিলেন দ্বিতীয় টার্মেও শেখ হাসিনা তাকে নমিনেশন দেবেন বা মেয়র বানাবেন। কিন্তু না, দলের পদের সবকিছু এখন শেখ পরিবারের দখলে। সে সূত্রে সাঈদ খোকনের জায়গায় শেখ হাসিনা তাপসকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেন। আর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তথা নৌকা মার্কা হলে তার বিজয় সুনিশ্চিত। তা মেয়রই হোক আর ইউপি সদস্যই হোক। সাঈদ খোকনের তা নিয়ে কোন ক্ষোভ থাকার কারণ নেই।

তাপস এসেই সুর তুললেন যে, সাঈদ খোকন বিশেষ বিশেষ কর্মকর্তার মাধ্যমে দুর্নীতি করেছেন। তিনি তার দৃষ্টিতে খোকনের অফিসারদের চাকরিচ্যুত ও পদচ্যুত করা শুরু করেন। তখনও খেলাটা তেমন জমে ওঠেনি। খেলা জমলো আরও একটু পরে। তাপস অভিযোগ করলেন যে, সাঈদ খোকন বিপুল অংকের টাকা খেয়ে সিটি কর্পোরেশনের মার্কেটে দোকান তুলে তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছেন। তাপস সেসব দোকান ভেঙ্গে দিতে শুরু করলেন। অভিযোগ তুললেন, সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট ও ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ নকশাবহির্ভূত বহু দোকান তৈরি করেছিলেন সাঈদ খোকন। তাপস এগুলো উচ্ছেদ শুরু করলে সাঈদ খোকন জানিয়ে দেন যে, ঐসব দোকান অবৈধ না। সকল নিয়ম-কানুন মেনেই ব্যবসায়ীদের দোকানগুলো অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু এই দোকানগুলো নিয়ে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে।

প্রায় দেড় হাজার অবৈধ দোকান উচ্ছেদের পর ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলু নিজে বাদী হয়ে সাঈদ খোকনসহ ডিএসসিসির ৭ জনের বিরুদ্ধে ৩৪ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার মামলা দায়ের করেন। এই মামলার পেছনেও তাপসের হাত আছে বলে মনে করেন সাঈদের অনুসারীরা। সাঈদ খোকনও বসে থাকেননি। এখন অনুসন্ধান করে তিনি জানতে পারেন যে, ডিএসসিসির যে ২৮টি ব্যাংক একাউন্ট ছিল সেটা কমিয়ে ৮টিতে নিয়ে আসা হয়েছে। আর ডিএসসিসির ফান্ডের একটা বড় অংশ তাপসের মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়েছে।

সাঈদ খোকন বলেন, টাকা-পয়সা তিনি স্থানান্তর করতে পারেন। কিন্তু সেটা যখন নিজের ব্যাংকে স্থানান্তর করেন তখনই তা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। এই টাকা যদি তিনি অন্য কোন ব্যাংকে স্থানান্তর করতেন তাহলে প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু এই অনৈতিক কাজ করে তাপস মেয়র পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। আমি তার মান-সম্মানের হানি ঘটাইনি। যেটা সত্য সেটাই বলেছি। ব্যাংকের যে অডিট রিপোর্ট আছে সেখানেই টাকা স্থানান্তরের প্রমাণ আছে।

এর মধ্যে গত ৯ জানুয়ারি শনিবার ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ ও সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটের উচ্ছেদ হওয়া ব্যবসায়ীরা ক্ষতিপূরণের দাবিতে হাইকোর্টের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করেন। ঐ মানববন্ধনে যোগ দিয়ে সাঈদ খোকন বলেন, দোকান বরাদ্দে কোন অনিয়ম হয়নি। দোকান মালিকদের কাছ থেকে ৫/৭ বছরের বকেয়া ভাড়া নিয়ে বোর্ড মিটিংয়ের মাধ্যমে সকল নিয়মকানুন অনুসরণ করে নকশা সংশোধন করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার তাপসকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, রাঘব বোয়ালের মুখে চুনোপুটির গল্প মানায় না। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে হলে সর্বপ্রথম নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত করুন। তারপর চুনোপুটির দিকে দৃষ্টি দিন। সিটি কর্পোরেশন আইন ২০০৯ দ্বিতীয় ভাগের দ্বিতীয় অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ (৯)(২)(জ) অনুযায়ী তাপস মেয়র পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।

এই অভিযোগের তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া দেননি তাপস। পরদিন ১০ জানুয়ারি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের ছবিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, কেউ যদি ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে কোন কিছু বলে থাকেন, সেটার জবাব দায়িত্বশীল পদে থেকে দেওয়াটা সমীচীন মনে করি না। সাঈদ খোকন যেটা বলেছেন সেটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। এটার কোন গুরুত্ব বহন করে না। এছাড়া সাঈদ খোকনের দেয়া অন্যান্য বক্তব্যও নিছক ভ্রান্ত। এই বক্তব্যের কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। ডিএসসিসির টাকা মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর প্রসঙ্গে তাপস বলেন, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে। এখানে আইনের কোন ব্যত্যয় হয়নি।

অর্থাৎ প্রকারান্তরে তাপস স্বীকার করলেন, ডিএসসিসির ফান্ড তিনি তার মালিকানাধীন মধুমতি ব্যাংকে পাঠিয়েছেন। এই কাজটা তো নৈতিক হয়নি।

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। সোমবার মানিকনগরের বক্স কালভার্টের বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম পরিদর্শনকালে তাপস সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, সাঈদ খোকন ঘটা করে সভা ডেকে আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করলেন। আমার কাছে মনে হয় এটা তার ব্যক্তিগত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ। গত ১৭ মে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। সেটা চলমান রয়েছে। মার্কেট সংক্রান্ত তথ্য সংবাদকর্মীরাই অনুসন্ধান করে বের করেছেন। সেখানে টাকা লেনদেন হয়েছে। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বা আমি কোন অভিযোগ আনিনি। সেখানে অবৈধ ব্যবসায়ীরা অর্থ লেনদেন করেছেন। তিনি এখন পুরো দায়িত্ব আমার ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। আমি মনে করি এটা অনভিপ্রেত। শুধু ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে তিনি এসব অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, সাঈদ খোকন অবশ্যই মানহানিকর বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি নিজেকে চুনোপুটি দুর্নীতিবাজ হিসেবে স্বীকার করেছেন। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ অবশ্যই মানহানিকর হয়েছে। আমি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে পারি। এর জন্য তো আইনি ব্যবস্থাই নিতে হবে।

ব্যারিস্টার তাপস এই বক্তব্য দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সিএমএম আদালতে তাপসের মানহানির পৃথক মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সরওয়ার আলম ও কাজী আনিসুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। মান গেল তাপসের; সংক্ষুব্ধ হলেন সারওয়ার আর ভূতের গলির আনিসুর। আজব না? তবে ঘটনার বোধহয় এখানেই শেষ হলো না। সাঈদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিবাদে ঢাকাবাসীর ব্যানারে বিক্ষোভ হয়ছে। তাপসের মানহানির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন আইনজীবীরা। নান্টু দা আর পল্টু দার লড়াই বেশ জমে উঠেছে। তবে শেষ পর্যন্ত সময়ই সব ঠিক করবে-এমন দাবি করে তাপস বলেছেন, তিনি তো মামলা করেননি। যারা মামলা করেছেন, তিনি তাদের মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বলেছেন।

সাঈদ খোকন যখন মেয়র ছিলেন, তখন তার নাম চালু হয়েছিল ‘মিঃ টেন পারসেন্ট’। অর্থাৎ সকল কাজে তাকে দশ শতাংশ দিতে হবে। এর সত্যতার কোন প্রমাণ নেই। সিটি করপোরেশনে ট্যাক্স দেয়া ছাড়া আমার তাদের সংগে কোনো কাজ নেই। ফলে আমি কখনও এক পার্সেন্টও দেইনি। কখনও কখনও দশাচক্রে ভগবানও ভূত হয়। তাপস মিঃ কত পার্সেন্ট আমার জানা নেই। ‘তবে নান্টু দা জিতে গেছে।’ পল্টু দা হেরে গেছে। নচিকেতার গানে পল্টু দা চোর ছিল, আর নান্টু দা আরও বড় চোর। এগুলো গানের কথা। বাস্তব সত্য কি সত্যি প্রকাশ পাবে?

https://dailysangram.com/post/440584