১৫ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ৭:১৯

২৪ ঘণ্টা থেকে ১৫ দিনেই জামিন পাচ্ছে ধর্ষণ মামলার আসামিরা

চব্বিশ ঘণ্টা থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে বেশির ভাগ ধর্ষণ মামলার আসামি। ভিকটিম ব্লেমিং, সাক্ষীদের ঝামেলা এড়ানোর মানসিকতা, অপর্যাপ্ত বিচারক, ওসিসিতে দক্ষ পুলিশ ও আইনজীবীর অভাব থাকায় দেশে অনেক ধর্ষণ মামলার বিচার নিশ্চিত না হওয়ার কারণ বলে উঠে এসেছে এক গবেষণায়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ২০১২ থেকে ২০১৭তে ঘটে যাওয়া ২৫টি ধর্ষণ মামলার বর্তমান অবস্থা, মামলা পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণগুলো তুলে ধরা হয়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভিকটিম ব্লেমিং কিভাবে বন্ধ করা যায়, তা চিন্তা করতে হবে। বিচারহীনতা বন্ধ না করলে এসব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। অপরাধীর স্বীকার করে নেয়া ঘটনাগুলোতেও ভিকটিমকেই দোষ দেয়া হয়। সমস্যার সমাধানে মনমানসিকতার মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। পুলিশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি মনমানসিকতার পরিবর্তন না আনলে এসব থেকে মুক্ত হতে পারব না।

এমজেএফের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গ্রেফতারের পর ২৪ ঘণ্টা থেকে ১৫ দিনেই আসামি খালাস পেয়েছেন ২৫টি মামলাতেই। ছয় মাসে চার্জশিট হয়েছে ২২টি মামলায়। এই ২৫টি মামলার মধ্যে তিনটি নিষ্ক্রিয় আছে, ২০টি মামলার অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়েছে। তিনটি মামলাতে এখনো অভিযোগপত্রই দেয়া হয়নি। তিনটি মামলায় অভিযুক্ত ধর্ষক কারাগারে রয়েছে এবং দুইজন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি তাদের গ্রেফতারও করা হয়নি। উপরন্তু অধিকাংশ আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে মামলাকে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। এই ২৫টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে অধিকাংশই বিচারাধীন ও সাক্ষ্যের পর্যায়ে রয়েছে। মামলা দায়েরের পর থেকে ছয় মাসের মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ২২টি মামলায়। তবে ২০১৪-২০১৫ সালে চার্জশিট হয়েছে এ রকম ৯টি মামলার রায় এখনো হয়নি। ২০১৬-২০১৭ সালে চার্জশিট হয়েছে এ রকম ১২টি মামলার রায় এখনো হয়নি এবং দু’টি ক্ষেত্রেই তেমন কোনো অগ্রগতিও হয়নি।

দেশের ১০টি জেলা- ঢাকা, গাজীপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর এবং জয়পুরহাট থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে এমজেএফ। এই ২৫টি মামলার মধ্যে দু’টি মামলা একদম নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে। চারটি মামলার নথি পাওয়াই যাচ্ছে না। যে ২০টির চার্জশিট হয়েছে, সেগুলোর ৬-২৩ বার শুনানি হয়েছে। একটি মামলার এখনো মেডিকো-লিগ্যাল টেস্ট হয়নি। দেখা গেছে বেশির ভাগ সাক্ষী হাজির না হওয়াতে এসব মামলার তারিখ পিছিয়ে গেছে। অভিভাবকরা হতাশ হয়ে আর কোর্টে যেতে চাইছেন না। দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক অসুবিধার জন্য মামলা চালাতে নারাজ।

আইনজীবী এলিনা খান বলেন, ভিকটিম ব্লেমিং বন্ধ করে কিভাবে তার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারি, তা ভাবতে হবে। দেশে বিচারকের স্বল্পতা খুবই বেশি। এসব কারণে আসামির বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। দেশে আইন আছে কিন্তু তা কার্যকর নেই। সাক্ষ্য আইনের পরিবর্তন জরুরি। রেপিস্টের সাথে ভিকটিমের বিয়ের প্রতিবাদ করেছি আমরা। দেশে কোনো ফরেনসিক ল্যাব নেই, তাই আলামত সংগ্রহে দেরি হয়। সেটাতেও সুযোগ পায় আসামি।

তিনি আরো যোগ করেন, ওসিসিতে দক্ষ আইনজীবী বা খুব দক্ষ পুলিশ কম থাকে। তারা ঠিকভাবে এফআইআর লিখতে পারে না। সেই দুর্বলতার কারণে আসামি খালাস পেয়ে যায়। মেডিক্যাল ফর্মটা এমন করে বাংলা ও ইংরেজিতে করা হয় যে, বাদি অনেক ক্ষেত্রেই বুঝতে পারে না। সেটাতেও অনেকে সুযোগ পায়। এসবই ঠিক করতে হবে।

এমজেএফের প্রতিবেদনে দেখা গেছে অভিযুক্ত পাঁচ আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে মামলাকে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। ভিকটিম ও তার পরিবারকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করাসহ নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে চারজন অভিযুক্ত অপরাধী। মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য না দেয়ার জন্য ভীতি প্রদর্শন করছে চারজন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের প্রভাবিত করে বিভিন্ন মাধ্যমে সহিংসতার শিকার নারী ও তার পরিবারকে আপস রফা করতে চাপ প্রয়োগ করছে ছয়জন অভিযুক্ত। ভিকটিমকে সহযোগিতা করার জন্য যে সমাজকর্মীরা এগিয়ে এসেছেন, তাদের হুমকি দিয়ে নিবৃত্ত করার অপচষ্টো করছে দুইজন।


উল্টো দিকে দেখা গেছে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীকে অশোভন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন, ধর্ষণের ঘটনাটি পুনরাবৃত্তি করে ভিকটিমকে বর্ণনা করতে বাধ্য করেন এবং নানাভাবে চরিত্র হনন করেন। অভিযুক্তকে আটক করার ক্ষেত্রে অনীহা বা ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। এ ছাড়া অস্বাভাবিক দেরিতে ভিকটিমের মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয় বলে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। মেডিক্যাল রিপোর্ট সঠিকভাবে লেখা হয় না। ভিকটিমের বয়সের সাথে ধর্ষণের মামলা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হলেও রিপোর্টে বয়স সঠিকভাবে লেখা হয় না।

অস্বাভাবিক দেরিতে যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, তা ভিকটিমকে সরবরাহ করা হয় না। দেশের বেশির ভাগ জেলা সদর হাসপাতালে ভিকটিমের বয়স নির্ধারণের ব্যবস্থা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই ডিএনএ টেস্ট করা হয় না। আর হলেও আসামি ডিএনএ টেস্টের ফলাফল প্রভাবিত করে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/555890