১৫ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ৭:০৬

ধান উৎপাদনের হিসাব মিলছে না

লাগামহীন চালের দাম দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ

সরকারের কৃষি বিভাগের হিসাব আর মাঠ পর্যায়ের হিসাব মিলছে না। কৃষি বিভাগের দাবি, চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই অস্থির হয়ে উঠছে চালের বাজার। লাগামহীন চালের দাম দুর্ভোগে ফেলছে সাধারণ মানুষকে। তাই চাল উৎপাদনের তথ্য নিয়ে ‘প্রশ্ন’ উঠেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলে কেন চাল আমদানিতে যেতে হচ্ছে? মাঠ পর্যায় থেকে ফসল উৎপাদনের সঠিক চিত্র আসছে না বলে সম্প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।

কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মাঠ পর্যায় থেকে নমুনা নিয়ে তারা উৎপাদনের তথ্য দেন। যদিও লোকবলের সংকট আছে। করোনাভাইরাসের কারণে তারা এবার মাঠ পর্যায়ে সেভাবে যেতে পারেননি। চালের চাহিদার তথ্য সঠিক না হলে প্রকৃত উৎপাদনের তথ্য দিয়েও সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না বলেও জানিয়েছেন তারা।

গত বছরের আগস্টে চালের মজুত নিয়ে এক সেমিনারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) পূর্বাভাস দিয়েছিল, চাহিদা মেটানোর পরও সাড়ে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। নবেম্বরের (২০২০ সালের) মধ্যে আউশ ও আমনের উৎপাদন যুক্ত হলে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কায় থাকবে না।

পরে ডিসেম্বরে ব্রি এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য চাহিদা পূরণ করেও আগামী বছরের (২০২১) জুন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। একই সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও (বিবিএস) উৎপাদনের তথ্য দেয়।

চলতি মৌসুমে এক কোটি ৫৬ লাখ টন আমন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। কিন্তু এবার আমনের ভর মৌসুমে মোটা চালের কেজিপ্রতি দাম ৫০ টাকায় পৌঁছেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে চাল আমদানি করা হচ্ছে ।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় বলেন আর বিসিএস-ই বলেন, তারা প্রতি জেলায় ৫ কাঠা, ১০ কাঠার ডেমোনেস্ট্রেশন (প্রদর্শন) ফার্ম করেন, প্লট করেন। সেই প্লটে যে প্রোডাকশন হয়, এর ওপরই তারা হিসাব দিয়ে দেয়। এই হিসাবে তো আমাদের চলবে না।

উৎপাদনের যে হিসাব আসছে তা সঠিক কি-না, এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আমি তা জোর গলায় বলব না। সেটা এগ্রিকালচার ও বিসিএসই বলুক।

গত ৭ জানুয়ারি কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মাঠ প্রশাসন থেকে চাল উৎপাদনের বিষয়ে সরকারকে সঠিক তথ্য না দেয়ার অভিযোগ ওঠে। অসম্পূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ তথ্যের কারণে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে বলে জানান স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।

কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ময়মনসিংহ-৯ আসনের সাংসদ আনোয়ারুল আবেদীন খান বলেন, গত মিটিংয়ে এটা (উৎপাদনের ত্রুটিপূর্ণ তথ্য) নিয়ে কথা হয়েছে। মাঠ থেকে যে তথ্য আসে সেই তথ্যের সাথে বাস্তবের অমিল খুঁজে পেয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ কারণে কমিটির সভাপতি (মতিয়া চৌধুরী) ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, বাস্তব ও মাঠের চিত্রের মধ্যে অনেক অমিল, এটা ঠিক রাখার চেষ্টা করুন। এত চাল উদ্বৃত্তের কথা যদি আপনারা বলেন, তবে সরকারকে চাল আমদানি করতে হবে কেন? পরবর্তী সময় এটা যাতে আর না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য বলেছেন তিনি (সভাপতি)।

তিনি আরও বলেন, আমিও মনে করি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ যারা আছে তারা আসলে উৎপাদনের বিষয়ে সঠিক তথ্য দেয়নি। উদ্বৃত্তের কথা বলা হচ্ছে আবার কিনতে হচ্ছে, কথা তো দিনরাত তফাৎ হয়ে গেল! এ বিষয়টি এবার ধরা পড়ল।

উৎপাদনের তথ্যের বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, আমাদের জনবল সঙ্কট রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা সঠিক হিসাব দেয়ার চেষ্টা করি।

তিনি আরও বলেন, আমনের উৎপাদনের হিসাব এখনও আমরা চূড়ান্ত করিনি। ফসল কাটা এখনও শেষ হয়নি। এবার উৎপাদন তো কম হবেই, বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে– এটা তো আমরা বলেছি। এক লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এবার আমনে এক কোটি ৪০ থেকে ৪২ লাখ টন চাল উৎপাদন হতে পারে বলে আমরা মনে করছি। আমাদের হিসাবের পর আবার বিসিএসের সঙ্গে মিলিয়ে থাকি।

মহাপরিচালক বলেন, আমরা একভাবে রিপোর্ট তৈরি করি, বিবিএস আরেকভাবে করে। আমাদের স্যাম্পল (নমুনা) নেয়ার পরিমাণ বেশি, কারণ আমাদের মাঠ পর্যায়ে লোক আছে। স্যাম্পল বেশি নেয়ার কারণে আমাদের হিসাবটা যুক্তিসঙ্গত মনে করি।

আসাদুল্লাহ বলেন, আমরা এই (উৎপাদনের হিসাব) প্রক্রিয়াটায় আরও কাজ করব। যাতে আরও বেশি স্যাম্পল নিয়ে অ্যাভারেজ (গড়) করে উৎপাদনের হিসাবটা দিতে পারি।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, উৎপাদন বেশি হলেই যে চালের দাম বাড়বে না, এমন তো কোনো কথা নেই। মজুত করেও তো দাম বাড়ানো যায়। মজুতের মাধ্যমে বাজারে চালের সরবরাহ কমে গেলে দাম বেড়ে যাবে। অনেকে লাভের আশায় ধান ধরে রাখছেন। এটা তো একটা ফ্যাক্ট।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উৎপাদনের হিসাবের প্রক্রিয়া তুলে ধরে তিনি বলেন, নমুনা হিসেবে কিছু কৃষকের সঙ্গে কথা বলি– এক বিঘা জমিতে কত মণ ধান হয়েছে। আমরা ১০-১২ জন মানুষ আমাদের পক্ষে তো সারাদেশে যাওয়া সম্ভব নয়। যাদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছি তারা যদি ভুল তথ্য দেয় সেটা ধরা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে তথ্য নেই। কোথাও ফোনে কথা বলি। আমরা কোনো কোনো স্থানে ধান কেটে মেপে, ময়েশ্চার অ্যাডজাস্ট করে হিসাব করি। এবার করোনার কারণে তো মাঠ পর্যায়ে যাওয়া যায়নি, অনলাইনে কাজ করতে হয়েছে।

সাইফুল ইসলাম বলেন, জনসংখ্যা যেটা ধরে হিসাব করি, প্রকৃত সংখ্যা সেটার থেকে বেশি হলেও সমস্যা থাকবে, হিসাব মেলানো যাবে না। এবার আমনের উৎপাদন কম হয়েছে এটা সরকার স্বীকৃত। ১০ শতাংশ কম হলেও ১৫ লাখ টন কম হবে। যেটুকু নষ্ট হয় তা বাদ দিলেও তো খাদ্যের অভাব হওয়ার কথা নয়।

তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রতিজন ৩৬৭ গ্রাম চাল খায়। করোনার কারণে অনেক মানুষ বিদেশ থেকে এসেছে। তারা খাচ্ছে। জনসংখ্যার হিসাব অনেক দিন আগের। হিসাব ঠিকঠাক থাকলে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন খাবার উদ্বৃত্ত থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

https://dailysangram.com/post/440592