১৫ জানুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ৬:৫৬

কালেমা তাইয়্যেবার অর্থনৈতিক তাৎপর্য

-শাহ্ আব্দুল হান্নান

‘তোমরা কি দেখ না যে, আল্লাহ তায়ালা কোন জিনিসের সাথে কালেমা তাইয়্যেবার তুলনা করেছেন। এটার দৃষ্টান্ত হলো, যেন একটি ভালো জাতের গাছ যার শিকড় মাটির গভীরে দৃঢ় নিবদ্ধ হয়ে আছে এবং শাখাগুলো আকাশ পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা প্রত্যেক মৌসুমে তার ফল দান করে তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। এসব উদাহরণ আল্লাহ এই জন্য দিয়েছেন যেন মানুষ এটা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। আর নাপাক কালেমার উদাহরণ হচ্ছে, একটি খারাপ জাতের গাছ, যা মাটির উপরিভাগ থেকে উপড়ে ফেলা যায়, এর কোনো দৃঢ়তা নেই। যারা প্রতিষ্ঠিত প্রমাণিত বাক্যে বিশ্বাসী আল্লাহ তাদের দুনিয়া ও আখিরাত-দুই জায়গাতেই প্রতিষ্ঠা দান করবেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন। (সূরা ইবরাহীম: ২৪-২৭)


শব্দের তাৎপর্য : ‘কালেমা তাইয়্যেবা’র শাব্দিক অর্থ- পাক ও পবিত্র কথা। এর তাৎপর্য হলো, সত্য কথা ও নেক নির্মল আকিদা বিশ্বাস, যা পুরাপুরি প্রকৃত সত্য ও ন্যায়পরায়ণতার ওপর ভিত্তিশীল হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এ হলো তাওহিদের স্বীকৃতি। কেননা, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব হচ্ছে আসল সত্য কথা।

(তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইবরাহীমের তাফসির)
কালেমায়ে খবিসা, এটা কালেমায়ে তাইয়্যেবার বিপরীত। প্রত্যেক সত্যের বিপরীত ও ভুলভিত্তিক কথা বা বিষয়কেই ‘খবিসা’ কালেমা বলা চলে। এখানে এর অর্থ প্রত্যেক ভুল মতবাদ যাকে ভিত্তি করে মানুষ নিজের জীবন গড়ে তোলে। তা নিছক নাস্তিকতাও হতে পারে, হতে পারে শিরক-বিদআত বা নবীদের মাধ্যমে প্রাপ্ত নয় এমন মতবাদ। (প্রাগুক্ত)


কাওলে সাবিতের অর্থ প্রতিষ্ঠিত বা প্রমাণিত কথা। এখানে এর অর্থ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। (নাসাফি, কাশশাফ)

তাফসিরকারদের আলোচনা :
মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী একটি আয়াতের ওপর ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, কালেমায়ে তাইয়্যেবা হচ্ছে মহাসত্য। আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত গোটা সৃষ্টি এ মহাসত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ কারণে প্রাকৃতিক আইন ও নিয়ম কোনো দিক দিয়েই এর সাথে সংঘর্ষশীল হয় না। এটি এমন এক তাৎপর্যপূর্ণ কালেমা, যে ব্যক্তি বা জাতিই একে ভিত্তি করে নিজ জীবনের ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, সে সবসময় এর সুফল লাভ করবে। সে চিন্তায় পরিপূর্ণতা, স্বভাব-চরিত্র নির্মলতা, প্রকৃতিতে ভারসাম্য, নীতির দৃঢ়তা ও নৈতিক পবিত্রতা, পারস্পরিক কাজকর্মে ন্যায়পরায়ণতা, ওয়াদা, প্রতিশ্রুতিতে পরিপক্বতা, সামাজিক সুনীতি, অর্থনীতিতে ইনসাফ ও সহানুভূতি, রাজনীতিতে বিশ্বস্ততা, যুদ্ধে ন্যায্যতা, সন্ধিতে আন্তরিকতা ও চুক্তিতে নিষ্ঠা সৃষ্টি করে।

অন্য দিকে খবিস কালেমা বা ভুল বিশ্বাস মূল সত্যের বিপরীত। তা প্রাকৃতিক আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটা কেবল তিক্ত ফলই দিতে পারে। কালেমা তাইয়্যেবা সব সময় একই ছিল। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা। কিন্তু খবিস কালেমা অসংখ্য। কালেমা তাইয়্যেবাকে কখনো সমূলে বিনাশ করা সম্ভব হয়নি। অন্য দিকে নিত্যনতুন খবিস কালেমা পয়দা হয়েছে। ইতিহাস অসংখ্য মৃত ও বিলুপ্ত খবিস কালেমাতে পূর্ণ।

কালেমা তাইয়্যেবা একটি দৃঢ় ও স্থায়ী দৃষ্টিকোণ দেয়। মানুষের সব সমস্যার সমাধান এ মহামন্ত্রে রয়েছে। কালের আকর্ষণ এটার ভিত্তিকে শিথিল করতে পারে না। অপর দিকে চলার পথে এটা বিভ্রান্ত হওয়া হতে রক্ষা করে। যখন দুনিয়ার জীবন অতিক্রম করে সে পরকালে পদার্পণ করে, সেখানেও তাকে কোনো প্রকার দুশ্চিন্তা এবং দুঃখের সম্মুখীন হতে হয় না। (তাফহীমুল কুরআন, বঙ্গানুবাদ-ষষ্ঠ খণ্ড)

অর্থনৈতিক তাৎপর্য :
সূরা ইবরাহিমের একটি আয়াতে ইসলামী অর্থনৈতিক দর্শন, তত্ত্ব এবং নীতির মূলভিত্তি পাওয়া যায়। কালেমা তাইয়্যেবাতে তার অন্তর্নিহিত দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। কালেমা তাইয়্যেবাতে এক দিকে তাওহিদের অর্থাৎ এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং অন্য দিকে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মাধ্যমে আল্লাহর সর্বশেষ বিশুদ্ধ বিধানের নির্দেশ মানবজাতির জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। এসব আয়াতে বলা হয়েছে, একটি সঠিক বিশ্বাসই ভালো ফল দিতে পারে। মন্দ বিশ্বাস থেকে কোনো ভালো ফল আশা করা যায় না। কাজেই যথার্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য একটি যথার্থ বিশ্বাসের ভিত্তিমূল প্রয়োজন। আল-কুরআনের দৃষ্টিতে সে বিশ্বাস হচ্ছে তাওহিদ। তাওহিদের ওপর আল-কুরআনের মতে কেবল অর্থনীতির নয়, গোটা জীবন ও সমাজব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করতে হবে। তাতেই সমাজজীবনে কল্যাণ অর্জিত হবে।

উপরিউক্ত সাধারণ উক্তি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলেই দেখা যাবে, ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থাকে সঠিকভাবে সংগঠিত করা হলে তার স্বরূপ কেন প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ভিন্নধর্মী হবে, তারই মৌল সত্যটির দিকে আয়াতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কালক্রমে নতুন নতুন সমস্যার সমাধান সন্ধানের জন্য নতুন নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। সেসব তত্ত্বেও যুক্তিবাদকে নির্ভর করে নীতিনির্ধারণ ও তার বাস্তবায়ন দ্বারা নানা ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যবস্থাকেও সংগঠন করা হয়। অর্থনীতি ও সমাজনীতির ক্ষেত্রেও তা করা সম্ভব।

এসব ব্যাপারে গবেষক ও তত্ত্ববিদগণ একটি সমস্যা সমাধানে সম্ভাব্য একটি রূপকে তাদের নিজস্ব জ্ঞানলব্ধ যুক্তির সাহায্যে প্রাথমিকভাবে ধরে নেন এবং তাকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পরিধিতে প্রয়োগ করে প্রমাণ করতে প্রয়াসী হন। প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলে অন্য সম্ভাব্য বিকল্পকে ধরে আবার নতুন প্রয়াসী হন। প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলে অন্য সম্ভাব্য বিকল্পকে ধরে আবার নতুন প্রয়াস শুরু করেন। কিন্তু অর্থনীতি ও সমাজনীতি ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রয়াসে প্রমাণের সাফল্য ঠিক বৈজ্ঞানিকভাবে পূর্ণ ও সঠিক না হওয়ারই কথা। তার কারণ মানুষের আচরণ ও সমাজের অসংখ্য জটিলতার কাঠামোতে আচরণের নানা সঙ্ঘাত সম্পর্কে তথ্যের আকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতিই ত্রুটিহীনভাবে গড়ে তোলা সম্ভবপর হয়নি। সমাজ ও মানুষের আচরণ যত বেশি আধুনিকতাধীন চাপে পড়ছে তত বেশি বাড়ছে প্রভাব বিস্তারকারী। সুতরাং ততই বেশি বাড়ছে সামাজিক সমস্যা সমাধান ক্ষেত্রে তত্ত্ববাদকে নির্ভুল ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা সংশয়। আংশিক প্রয়োগে আংশিক ফল পাওয়ার তথ্য সাহায্যেই কেউ কেউ পেতে চান নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবনকারীর গৌরব। অথচ সে আংশিক নতুন তত্ত্ববাদ আংশিকভাবে স্বল্পকালের জন্য সুফল দিতে পারলেও কালক্রমে সেটুকু সুফল লাভের ভিত্তিটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নতুন পরিপ্রেক্ষিতে নতুন পরিস্থিতি একই পূর্ববর্তী সুফলদায়ক তত্ত্ববাদ অসামাজিক অকল্যাণ সৃষ্টি করতে পারে। আদর্শ স্মিথ-রিকার্ডো সৃষ্ট ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির তেমনি হয়েছে অবসান, ক্লাসিক্যাল অর্থনীতি ব্যবস্থার কুফলকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মার্কসবাদেরও হয়েছে অবসান। বর্তমান পৃথিবীতে কল্যাণের সন্ধান করছে পাশ্চাত্য, কল্যাণরাষ্ট্রের নতুন রূপের অর্থনীতি এবং একই কল্যাণের সন্ধান করছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর নানা মাত্রার সমাজতন্ত্রবাদ। এখনো যেসব সন্ধান অনুসন্ধান ও নতুন তত্ত্ববাদের বাস্তবায়ন সঠিক সুগঠিত রূপ নিয়ে মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ সৃষ্টির উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়নি, তা হতেও পারবে না কোনো দিন। কারণ ভিত্তিগত ধর্তব্য সত্য বা (ধীরড়স) চিন্তা ও অনুশীলন সম্পর্কেই রয়েছে গোড়ায় গলদ।

আলোচ্য আয়াত থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইসলামী তত্ত্ববাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রথমেই স্বীকৃতি দান করতে হবে ইসলামী ধর্তব্য axiom কে। প্রথম মৌল (axiom)-ই হলো তাওহিদ জ্ঞান। এ জ্ঞানের স্বীকৃতি থেকেই আসছে ধর্তব্যের দৃঢ় স্তম্ভ, যার সত্যতার পরিবর্তন হবে না। সে জন্যই এ ধরনের সত্যতাকে ভিত্তি করে যেসব Variable কে প্রমাণ করার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করতে হয় তার সংখ্যাও সীমিত। সেসব সীমিত (Variable)কে কঠোর সত্যনিষ্ঠ পদ্ধতিতে যুক্তি ও আল-কুরআন সুন্নাহর সমর্থন সম্পর্কের মূল্যায়ন সহজ পন্থা আর সঠিক পন্থায় পরিচালনা করা সম্ভব। আর এসব গবেষণা ও তত্ত্ববাদ সংগঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে অসত্য ও অকল্যাণের নির্দেশক তত্ত্ব এবং নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার ঝুঁকি থাকে খুবই কম। সে ঝুঁকি মানুষের উল্লিখিত সঠিক পদ্ধতিকে আয়ত্ত এবং প্রয়োগ করার দক্ষতার সীমাবদ্ধতার ওপরই নির্ভরশীল। সে কারণে বর্তমান বিশ্বও পূর্ণ দক্ষতার সীমাবদ্ধতার ওপরই নির্ভরশীল। সে কারণে বর্তমান বিশ্বেও পূর্ণ দক্ষতার সাথে সর্বাঙ্গীণ উপযোগী ইসলামী অর্থনীতি সমাজনীতি ব্যবস্থা সংগঠনের তত্ত্ববাদ ও নীতিনির্ধারণকে প্রতিষ্ঠিত রূপ দিতে পারলে দেখা যাবে, পরিবর্তনশীল পুঁজিবাদ ও পরিবর্তনশীল সমাজতন্ত্রবাদের চেয়ে সঠিক ভিত্তির ভারসাম্যপূর্ণ শোষণহীন সুবিচারমূলক ইসলামী ব্যবস্থা-ই বিশ্বে ও মানুষের জন্য সর্বত্রই সর্বোচ্চ কল্যাণপ্রসূ।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

https://www.dailynayadiganta.com/sub-editorial/555857