১৪ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৩

জন্ম নিয়েই নিষ্ঠুরতার বলি

কখনো রাস্তাঘাট, কখনো ঝোপঝাড়, কখনো ফুটপাত, কখনো বা ট্রেনের বগি, শৌচাগার বা নালা-নর্দমা, এমনকি ডাস্টবিনেও মিলছে সদ্যোভূমিষ্ঠ নবজাতক। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা এসব শিশুর বেশির ভাগ উদ্ধার হয় মৃত অবস্থায়। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ক্রমেই বাড়ছে নবজাতক হত্যার ঘটনা। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, গত ছয় বছরে রাজধানীতে উদ্ধার করা হয় ২১০টি নবজাতকের লাশ। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর মাসে রাজধানীতে অন্তত ২০টি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের ভাষ্য মতে, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর উঁচু ভবন থেকে নিচে ফেলায়, ডাস্টবিনে কুকুরের কামড়, কাপড় বা প্যাকেটে বদ্ধ অবস্থায় থাকায়, চুক্তিবদ্ধ ধাত্রীরা নাড়ি না কেটে ফেলে রাখায় কিংবা অনাহারে পড়ে থাকায় এসব শিশুর মৃত্যু হয়। এই নিষ্ঠুর হত্যার সঙ্গে জড়িত নবজাতকের মা-বাবা এবং কিছু মেটারনিটি ক্লিনিকের কর্মী। অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুকে নিয়ে সামাজিক হেনস্তার ভয়ে যাঁরা এই নিষ্ঠুর কাজ করছেন, তাঁরা একে হত্যাকাণ্ডই মনে করছেন না। আবার এসব ঘটনায় নবজাতকের মা-বাবাকেও শনাক্ত করা যাচ্ছে না। হচ্ছে না তদন্তও।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নবজাতকের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ সাধারণ ডায়েরি এবং অপমৃত্যু মামলা করায় ময়নাতদন্ত হয়। ময়নাতদন্তের ভিত্তিতে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ডিএনএ প্রফাইলও তৈরি করে, কিন্তু উন্নত দেশের মতো ডিএনএ ব্যাংক না থাকায় পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেলে দেওয়ার পর যেসব নবজাতক ভাগ্যগুণে বেঁচে যায়, তাদের অনেকে নিঃসন্তান মা-বাবার কাছে আদরে বেড়ে উঠছে। সন্তান দত্তক নিতে উত্সুক বহু পরিবার। অন্যদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছোটমণি নিবাসসহ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিয়ে এসব শিশু লালন-পালন করছে।

সমাজবিজ্ঞানী, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, সচেতনতার অভাবে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ সন্তান জন্ম নিচ্ছে। পরে লোকলজ্জার ভয়ে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। এই সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর তদন্তের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে উদ্ধার করা হয় ২১০টি নবজাতকের লাশ। এর মধ্যে ২০১৯ সালে উদ্ধার করা হয় ৪২টি লাশ। ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিনটি নবজাতকের লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে।

শাহবাগ থানার ওসি মামুন অর রশীদ বলেন, ‘এসব ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অপমৃত্যুর মামলা করে, কিন্তু নবজাতকের মা-বাবার পরিচয় পাওয়া যায় না। আমরা রুটিনমাফিক লাশগুলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠাই।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘নবজাতকের লাশেরও ময়নাতদন্ত করতে হয়। তবে উদ্ধার হওয়া সব লাশের ময়নাতদন্ত হয় না। বেশির ভাগ রিপোর্টে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই হত্যার আলামত উল্লেখ করা হয়। এ শিশুগুলো সাধারণত প্রিম্যাচিউরড হয়। শরীরের টিস্যু বা হাড় সংগ্রহ করে ডিএনএ প্রফাইল তৈরি করে আমরা সিআইডিতে পাঠাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘নবজাতকদের সঙ্গে ডিএনএ প্রফাইল ম্যাচ করা আমাদের দেশে অসম্ভব। কারণ আমাদের ডিএনএ ব্যাংক নেই। এটি থাকলে অনেক অপরাধ কমে যেত।’

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) রুমানা আক্তার বলেন, ‘উদ্ধার করা নবজাতকদের ডিএনএ পাওয়া গেলেও তাদের মা-বাবার ডিএনএ স্যাম্পল নেই। তাই পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তবে মা-বাবার পরিচয়ে সন্দেহ থাকলে তাদের নিয়ে পরিচয় যাচাই করা যায়।’

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান কালের কণ্ঠকে বলেন, সামাজিক হয়রানির ভয়েই মূলত এসব নবজাতককে হত্যা করা হচ্ছে। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এভাবে নবজাতক হত্যা করে ফেলে রাখলে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হতো। একটি শিশু জন্ম নেওয়ার পর তার বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। পুলিশ প্রশাসনের উদাসীনতায় এসব ঘটনা জানা যাচ্ছে না। হাসপাতাল, মেটারনিটি, অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি করে না পুলিশ।

পুলিশ সূত্র জানায়, কখনো নবজাতকের মা শনাক্ত হলে বেরিয়ে আসে মর্মস্পর্শী ঘটনা। নেহাত বিপদে পড়েই মা তাঁর গর্ভের সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন। ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের একটি বাড়ি থেকে নবজাতককে ফেলে দেন তার কিশোরী মা বিউটি আক্তার। হতভাগ্য সেই নবজাতককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করা হয়। ২৫ দিন পর শিশুটি মারা যায়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মা বিউটি আক্তার জানান, তাঁর ভগ্নিপতি তাঁকে ধর্ষণ করায় তিনি গর্ভবতী হন। লোকলজ্জার ভয়ে তিনি এই নির্মম কাজ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক জিনাত হুদা ওয়াহিদ বলেন, ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে এসব ঘটনায় অমানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আবার কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েও সামাজিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ। কিন্তু এসব পরিস্থিতির জন্য তো শিশুটি দায়ী নয়। সে তো সৃষ্টিকর্তার দান। তাকে হত্যা করা যাবে না। সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে হবে।

বেঁচে গেলে ভিন্ন চিত্র

মানবাধিকারকর্মী ও সমাজকর্মীরা বলছেন, ফেলে দেওয়ার পর যেসব নবজাতক বেঁচে যায় তারা ভালোভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। মা হতে পারছেন না দেশে এমন অসংখ্য নারী রয়েছেন। এ অবস্থায় এসব নবজাতক কখনো কখনো হয়ে ওঠে মহামূল্যবান সম্পদ।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, অনৈতিক সম্পর্ক থেকে বা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে যেসব সন্তানের জন্ম হয় তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে সন্তান দত্তক দেওয়ার প্রতিষ্ঠান আছে। নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা যাবে না।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/01/14/994925