১৪ জানুয়ারি ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৪

লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ

একটি জীবন কেবল একজন মানুষের একক জীবন নয়! এর সাথে আরো অনেক মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে। একটি জীবন বিচ্ছিন্ন হলে তখন অন্য জীবনেও যন্ত্রণা নেমে আসে। প্রতিনিয়ত সড়ক ও রেল দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। একের পর এক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য পরিবার অভিভাবকহারা হচ্ছে। গত ১০ ডিসেম্বর জয়পুরহাট সদরের পুরানপৈল লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন-বাস সংঘর্ষে ১২ জন বাসযাত্রী নিহতের ঘটনাই প্রমাণ করে রেলের লেভেল ক্রসিং কতটা অনিরাপদ। দুর্ঘটনার সময় রেলগেটটি খোলা ছিল। কিন্তু গেটম্যান কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এটি কেবল একটি দুর্ঘটনা তা কিন্তু নয়! এটি একটি হত্যাকাণ্ড। ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতা যাওয়ার জন্য যত ফন্দি করা হয় তার ছিটেফোঁটাও যদি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করা হতো, তাহলে এভাবে লেভেল ক্রসিংয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হতো না।

লেভেল ক্রসিং হচ্ছে রেললাইনের উপর দিয়ে যাওয়া সড়কের সংযোগস্থল। কিছু সংযোগস্থল রক্ষিত (পাহারাদার আছে)। আর কিছু অরক্ষিত (পাহারাদার নেই)। রেলপথে মোট ক্রসিং আছে দুই হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার ৩৬১টির অনুমোদন নেই। আর এক হাজার ৪৯৫টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে ৬৩২টির গেটম্যান নেই। অবৈধ ক্রসিংয়ের বেশির ভাগ রাস্তা-ই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ও ইউনিয়ন পরিষদের। বিগত এক যুগে রেলওয়েতে এক লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও লেভেল ক্রসিংগুলোকে নিরাপদ করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যে কারণে একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আর একটি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ছোট একটি সতর্কীকরণ নোটিশ টাঙিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারে। কিন্তু একবারওভাবে না এটি ক্রসিং নামের মৃত্যুফাঁদ। যখনই দুর্ঘটনা ঘটে তখন দায়ী ব্যক্তিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। রেলওয়ের সূত্রে দেখলাম, গত এক যুগে ছোট-বড় সব মিলে প্রায় সাড়ে আট হাজার দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার পর ৯ হাজার তদন্ত কমিটি হয়েছে। সব কমিটিই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু ৯০ ভাগ প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কারণ হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া প্রায় অসম্ভব। কেননা ঘটনার মূলে যারা বসে আছে, তারা সবাই হয় স্থানীয় রাজনীতিতে দলীয়ভাবে প্রভাবশালী না হয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। এ জন্য তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়লেও বাস্তবায়ন রিপোর্ট আলোর মুখ দেখতে পারে না।

রেলকে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব করার লক্ষ্যে সরকার ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেলপথ বিভাগকে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ে উন্নীত করে। কিন্তু রেলের বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, যাত্রী ভোগান্তি কিংবা দুর্ঘটনা কমেনি। উল্টো রেল দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। কোনোভাবেই যেন মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাচ্ছে না। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, অপরিকল্পিত ও অননুমোদিত সংযোগ সড়ক এবং সচেতনতার অভাবে দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে। গত আড়াই বছরে দেশে রেল দুর্ঘটনায় প্রায় আট শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন আরো ছয় শতাধিক। ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে লেভেল ক্রসিংগুলোয় ৩১০টি দুর্ঘটনায় ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত দুই বছরে লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সাথে অন্য যানবাহনের ৫৬টির মতো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ৮৪টি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের মোট অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ও এলজিইডির রাস্তা ৪২৭টি, সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২৪টি, পৌরসভার ১১০টি, সিটি করপোরেশনের ৩২টি, একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ২৭টি, জেলা পরিষদের ১৩টি ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তিনটি রয়েছে। এর বাইরে আরো ১২৭টি ক্রসিং রয়েছে। এআরআইয়ের তথ্যানুসারে, গত পাঁচ বছরে রেলপথে ৮৫৫ দুর্ঘটনায় ৯১৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

দেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। কিন্তু ক্রসিংগুলো কেন ডিজিটাল হচ্ছে না। এই প্রশ্ন যে কেউ উত্থাপিত করতেই পারেন। যেখানে রেলক্রসিং আছে সেখানে ১৫০ মিটার আগ থেকে ৫০ মিটার অন্তর অন্তর একাধিক গতি রোধক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও জ্বলজ্বল করে এমন বাতি বসানো হলে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসতে পারে। রাজধানীর ভেতরে থাকা ক্রসিংগুলোর উপর কিংবা নিচ দিয়ে যান চলাচলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্ঘটনা কমবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও লেভেল ক্রসিং উন্নয়নে যথাযথ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। কেন করা হয়নি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন। রেলওয়ে প্রকৌশলী ও অবকাঠামো দফতর সূত্র থেকে জানা যায়, ক্রসিংগুলোতে কর্মরত ৭৫ শতাংশ লোকই দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করছেন।

এতে সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তা বেশি লাভবান হচ্ছেন। এ প্রক্রিয়ায় দক্ষ-অদক্ষ যাচাই-বাছাই না করেই লোক নিয়োগ দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে যে, এ কাজটি করার জন্য একটি অসাধু চক্র গড়ে উঠেছে। এ ছাড়াও অস্থায়ী ভিত্তিতে যারা কাজ করে তাদের বেতনের একটি অংশ চক্রের মাধ্যমে রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তার পকেটে চলে যায়। স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী গেটম্যানদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। ১৯৮৪ সালের পর থেকে রেলে কোনো স্থায়ী গেটম্যান নিয়োগ দেয়া হয়নি। আর অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত গেটম্যানরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হওয়ার কারণে ক্রসিংগুলোয় দুর্ঘটনা ঘটছে।

রেলপথের একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে সাধারণ মানুষের প্রবেশ আইনত দণ্ডনীয়; কিন্তু এ আইন বাংলাদেশের মতো দেশের মানুষ কতটুকু মেনে চলে চলছে তা দেখার কেউ নেই। রেলওয়ে অধ্যাদেশ ১৮৯০ অনুসারে বিনা অনুমতিতে রেলপথের উপর দিয়ে হাঁটলে গ্রেফতারসহ দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে; কিন্তু কার্যকর দেখছি না। সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু শ্রেণীর মানুষ, যারাই রেল দুর্ঘটনা কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন না কেন, কোনো একটি ঘটনার বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত দেখিনি। বিচারহীনতা আর প্রতিকারহীন অবস্থায় যখন সব কিছু চলতে থাকে তখন সেখানে তো পুনরাবৃত্তি ঘটবেই। এটাই স্বাভাবিক! প্রশ্ন হচ্ছে, আর কত মানুষের প্রাণ গেলে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার মৃত্যুর মিছিল থামবে।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/555758/