১৩ জানুয়ারি ২০২১, বুধবার, ১১:৪৭

টিকায় আগ্রহ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব

এক সপ্তাহ পরই করোনার টিকা আসছে দেশে। টিকা আনা ও দেওয়ার সব প্রস্তুতিই এরই মধ্যে প্রায় সম্পন্ন। তবে এই টিকার গ্রহীতা অর্থাৎ যাকে টিকা দেওয়া হবে, সেই সব মানুষকে প্রস্তুত করার কাজটি এখনো বাকি রয়েছে। এ জন্য টিকা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে, দেশের মানুষকে টিকা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর প্রচার-প্রচারণা দ্রুত শুরু করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, যদিও সরকারের পক্ষ থেকেও টিকা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার ভেতর প্রচার-প্রচারণার অংশ রাখা হয়েছে।

এখনই ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা না চালালে টিকা নিয়ে মানুষের আগ্রহ শেষ পর্যন্ত কতটুকু থাকে, তা নিয়ে সরকারের কর্মকর্তাদের অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত। তাঁরা বলছেন, দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে মানুষ যখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে টেস্টের জন্য, তখন সরকার সঠিক মাত্রায় চাহিদা পূরণ করতে পারেনি; কিন্তু যখন সরকার সারা দেশে একের পর এক টেস্টিং ল্যাব চালু করেছে, তখন আবার বহু মানুষ টেস্টের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

ফলে সরকার এখন যাদের অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিয়ে তালিকা তৈরি করছে, তাদের সবাই টিকা নেবে কি না, সেটা নিয়েও মানুষের মধ্যে কৌতূহল বা প্রশ্ন বাড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে কেউ কেউ হয়তো সরকার নির্ধারিত টিকা এড়িয়ে নিজের পছন্দের অন্য কোনো টিকা নিতে আগ্রহী হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা টিকার জন্য উৎসাহজনক ও সচেতনতামূলক আগাম প্রচার-প্রচারণার ওপর জোর দিয়েছেন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন দায়িত্বশীল চিকিৎসক (তিনি প্রথম দফাতেই টিকা পাওয়ার তালিকায় আছেন) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কী করব বুঝতে পারছি না। আমি তো টিকা নিতে আগ্রহী ছিলাম, কিন্তু এখন আমার পরিবার সায় দিচ্ছে না। তারা ভয় পাচ্ছে। তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি, কিন্তু যেহেতু তারা পর্যাপ্ত তথ্য জানে না, তাই সংশয়ে পড়েছে। ফলে আমার পরিবারের অমতে শুরুতেই টিকা নেব কি না, তা নিয়ে আমিও এখন সংশয়ে আছি।’

একই রকমের সংশয়ের কথা জানিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নার্স কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি প্রথম দফায় টিকা পাব, কিন্তু আগে নেব না। অন্যরা নেওয়ার পর নেওয়ার কথা ভাবছি।’

ধানমণ্ডির ব্যবসায়ী আকরাম আলী বলেন, ‘টিকা নিয়ে অন্ধকারে আছি। ইউরোপ-আমেরিকায় তো দেখছি অনেকেই টিকা নিতে চায় না, এর তো কোনো কারণ আছে অবশ্যই। তারা তো আমাদের চেয়ে সচেতন বলেই মনে করি। ফলে দেখা যাক কী পরিস্থিতি দাঁড়ায়! মানসিকভাবে এখনো নিজেকে প্রস্তুত করতে পারিনি টিকা নেওয়ার জন্য।’

বাংলাদেশ ফার্মাকোলজিক্যাল সোসাইটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকা হাতে নিয়ে আসা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করার পর বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসছে মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করার বিষয়টি। যেসব দেশে এখন পর্যন্ত করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে, কোথাও তালিকা ধরে টার্গেট পূরণ হচ্ছে না। তালিকা অনুসারে টার্গেট ৫০ শতাংশের ওপরে ওঠেনি। এ ক্ষেত্রে আমাদের মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করার সবচেয়ে বড় টনিক হচ্ছে এই টিকার উপকারিতা সম্পর্কে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খোরশেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকা দেওয়ার জন্য প্রচার-প্রচারণার বিষয়টি দুইভাবে হচ্ছে। একটা অংশ করবে সরাসরি তথ্য মন্ত্রণালয়, আরেকটা অংশ করব আমরা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে। এ জন্য কারিগরি কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পোস্টার, লিফলেট, টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপনের নকশা-নমুনার কাজ চলছে দ্রুত।’

তিনি বলেন, ‘অনেকে হয়তো টিকা নেবে না, কিন্তু কোন ক্যাটাগরিতে কে দেবেন, আর কে দেবেন না সেটা তো আমরা আগেভাগে জানতে পারছি না। সুতরাং আমরা সেদিকে না তাকিয়ে সবার জন্যই টিকা আনব। যদি কেউ না দেয়, সেটা না হয় থেকে যাবে। আমরা চেষ্টা করব বেশি মানুষকে টিকা দিতে।’

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রচার ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কারিগরি বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুরুর দিকে টিকার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি থাকলেও একপর্যায়ে সেই আগ্রহ হারিয়ে যেতে পারে। সেদিক নজর রেখেই যেভাবে পরিকল্পনা করা হচ্ছে তার সব কিছু ঠিকঠাকমতো করা দরকার। এ ক্ষেত্রে আমরা মানুষকে সচেতন করতে নানা ধরনের প্রচার কৌশল হাতে নিয়েছি, যার খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই এক ধরনের পরীক্ষামূলক প্রকাশ ঘটবে।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমরা কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চাই, এর মধ্যে রয়েছে সব ক্যাটাগরির মানুষই যেন টিকা পেতে পারে। যারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পাবে, তাদের প্রতি অন্যদের যেন কোনো রকম বিরূপ মনোভাব কিংবা নিজেকে যেন কেউ বঞ্চিত মনে না করে, সে জন্য সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ধৈর্য ধরে পর্যায়ক্রমে টিকা নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা, টিকার প্রতি যাতে মানুষের কোনো ধরনের ভয় বা বিভ্রান্তি না থাকে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (টিকাদান) ডা. শামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনা এত বিধ্বস্ত করে ফেলার পরও আমেরিকার মতো দেশে এখনো টিকা না দিতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গত এক মাসে আমেরিকায় মাত্র ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া গেছে। এখনো আমেরিকার সরকার দুই কোটি ডোজের বেশি টিকা হাতে নিয়ে বসে আছে; দেওয়ার আগ্রহী মানুষ কম। আমাদের এখানেও এখন যতটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, টিকা আসার পর শেষ পর্যন্ত টিকা উদ্বৃত্ত থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কেউ টিকা দিতে না চাইলে তো তাকে জোর করে টিকা দেওয়া যাবে না। টিকা আসার পর আমরা প্রচার-প্রচারণা শুরু করব।’

আগে কেন করছেন না—এমন প্রশ্নের মুখে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে করলে সমস্যা আছে। মানুষ ভুলে যাবে। এমনিতে এখন সবাই কিন্তু গণমাধ্যমের বদৌলতে টিকা কবে আসবে, কিভাবে দেওয়া হবে তা মোটামুটি জেনে গেছে।’

অবশ্য অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘তথ্য যত আগে জানানো যাবে, ততই মানুষ বেশি করে নিজেকে প্রস্তুত করার সুযোগ পাবে। মানুষ যখন জানতে পারবে এই টিকা তার কী উপকার করবে, কতটা সে নিরাপদ থাকতে পারবে, তখন সে টিকা নিতে আগ্রহী হবে; সেটা যেকোনো উপযুক্ত মাধ্যমে বুঝিয়ে দিতে হবে।’

আসছে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকেই দেশের মানুষকে করোনার টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অবশ্য এর আগে কিছু স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবককে টিকা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী ২১ থেকে ২৫ জানুয়ারির মধ্যেই ভারত থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকা আসবে। টিকা দেওয়ার জন্য ২৬ জানুয়ারি থেকে অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন শুরু হবে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/01/13/994677